আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা : এ এক অচিনপুরের প্রাচীন কেল্লা। ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের গোয়ালিয়র শহরের এক প্রান্তে পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই কেল্লা। অসাধারণ স্থাপত্য ও কারিগরির চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর এক মায়াবী হাতছানি দিয়ে চলেছে পথচলতি মানুষদের। কেল্লা চত্বরে দাঁড়িয়ে গোটা গোয়ালিয়র শহরটা চোখে পড়ে। মনে হয় ওরা কত ছোট, বড্ড অসহায়।

সেবার একটা লম্বা ছুটিতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। গোয়ালিয়র শহর ঘোরার শেষ গন্ত্যব ছিল এই কেল্লা। প্রথমে মনে হয়েছিল কেল্লাতো সবই সমান, আর নতুন কি হবে? বেশ কয়েকবার ভেবেওছিলাম যাব না। কিন্তু সেখানে পৌঁছে বুঝতে পারলাম না এলে জীবনের অনেক কিছু অদেখা থেকে যেত।

শহরের মুখ্যস্থান থেকে অথবা ছোট-খাট ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া যায়। একটা গাড়ি নিয়ে আমরাও বেড়িয়ে পড়লাম ফোর্টের উদ্দেশ্যে। মান সিং যে বিলাসপ্রিয় ছিলেন তা কেল্লা দেখলেই বোঝা যায়। কেল্লার গায়ে চোখে পড়ল গাঢ় নীল রঙ দিয়ে নকশা কাটা। জানতে পারলাম এটা সে যুগের চাইনিজ মিনাকারি। প্রায় ৪০০ বছর পরেও তা অমলিন। গোটা কেল্লা জুড়ে অসামান্য স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন চোখে পড়ে। গুপ্ত পথ, যুদ্ধে যাওয়ার পথ, হাতি ঘোড়া যাতায়াতের পথ সব আলাদা করা হয়েছিল সে সময়ে। এমনকি শত্রু আমন্ত্রন রুখতে এবং আত্মরক্ষার জন্য অসামান্য বুদ্ধি প্রয়োগ করেছিলেন সে যুগের কারিগর। তবে যে গল্প আমার সবচেয়ে বেশি মন কেড়েছিল তা হল মৃগনয়নী৷

শোনা যায়, মান সিং একজন প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। তাই তিনি প্রায়শই ছদ্মবেশে বের হতেন রাজ্যের মানুষের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে। একদিন তিনি এমনই রাজ্য পরিদর্শনে বেড়িয়েছিলেন। তিনি দেখতে পান

ফোর্ট থেকে গোয়ালিয়র শহর৷

ফোর্ট থেকে গোয়ালিয়র শহর৷

এক পরমা সুন্দরী এক বুনো ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই করছে। তার চোখে মুখে ভয়ের লেশ মাত্র নেই। জানতে পারলেন এক গোয়ালার মেয়ে সে। ষাঁড়টি তাই পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল বলেই মেয়েটির এমন প্রচেষ্টা। সেদিন বাড়ি ফিরে এলেও মেয়েটিকে ভুলতে পারেনি মান সিং। কয়েকদিন পরেই তিনি সেই মেয়েটির কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। মেয়েটি রাজি হলেও, তিনি তিনটি শর্ত রাখেন রাজার সামনে। প্রথম শর্ত, তিনি রাজার অন্যান্য রাণীদের মতো পর্দার আড়ালে থাকবেন না। দ্বিতীয় শর্ত, তার ব্যবহারের সমস্ত জল জোগান দিতে হবে তার গ্রামের নদী থেকে এবং তৃতীয় শর্ত, রাজা যদি যুদ্ধে যান তবে তিনিও রাজার সঙ্গিনী হয়ে যুদ্ধে যাবেন। মানসিংহ সমস্ত শর্ত মেনে নিলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন রাজার অন্যান্য রাণীরা। তারা সকলেই রাজপুত ঘরানার মেয়ে তাই একই মহলে এক গোয়ালিনীর সঙ্গে থাকতে তাদের আপত্তি। রাজা ওই মেয়েটির প্রেমে এতটাই মত্ত ছিলেন যে তার জন্য আলাদা করে প্রাসাদ তৈরি করা

ফোর্টের ভেতরে যাওয়ার রাস্তার৷

ফোর্টের ভেতরে যাওয়ার রাস্তার৷

লেন। কিন্তু প্রবেশ দ্বার তৈরি করালেন সুরঙ্গের মাধ্যমে, যাতে অন্য কেউ ওই প্রাসাদে বাইরে থেকে ঢুকতে না পারে। নতুন রাণীর চোখ মন কেড়েছিল রাজার, তাই বিবাহের পর রাজা তার নাম রাখলেন মৃগনয়নী৷

মৃগনয়নীর সেই প্রাসাদ আজও চোখে পড়ে গোয়ালিয়র ফোর্ট থেকে, কিন্তু সুড়ঙ্গের পথ বিপজ্জঙ্ক বলে সেখানে আর যেতে দেওয়া হয় না। ফোর্টের মধ্যেও অসামান্য স্থাপত্য চোখে পড়ে। কেল্লার ভেতর রঙ্গিন কাঁচের ব্যবহার ছিল সে যুগে সূর্যের আলো বিকিরনের জন্য। তবে মাটির তলায় কেল্লার যে অংশ রয়েছে তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চোখে পড়ল একটি কুয়ো। শোনা যায়, মানসিংহের রাজত্বের পর ভারতে যখন মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার শুরু হয়েছিল তখন মুসলমানদের হাত থেকে নিজেদের সম্মান রক্ষা করতে রাণীরা ওই কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মবলিদান দিতেন।

শুধু মান সিংই নন, রাজপুত ঘরাণার পর মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার লাভের জন্য আকবর এই কেল্লায় রাজত্ব করছিলেন। কেল্লার পাশেই রয়েছে এক প্রাসাদ, শোনা যায় সম্রাট জাহাঙ্গিরের জন্ম হয়েছিল সেখানে। শাহজাহানও এই কেল্লায় রাজত্ব করেন। তবে ঔরঙ্গজেবের সময় এই কেল্লা ছিল কয়েদিদের আস্তানা। এখানে বন্দীদের রাখা হত, এমনও শোনা যায় প্রচুর বন্দীকে এই কেল্লার চত্বরে কবর দেওয়া হয়েছে।

ফোর্টের ভেতর৷

ফোর্টের ভেতর৷

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর এই কেল্লায় রাজত্ব করেছিলেন সিন্ধিয়া রাজপরিবার। সে সময়ে ভারতে সিপাহি বিদ্রোহ চলছে। ইতিহাস সাক্ষী, ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাঈ গুলিবিদ্ধ হয়ে সাহায্যের আশায় এসেছিলেন এই কেল্লায়। তবে রাজপরিবারের তরফে কোনও সাহাজ্য না পেয়ে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তাঁকে।

এত কথা শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। একটা কেল্লাকে ঘিরে এত ইতিহাস লুকিয়ে থাকতে পারে? গোটা কেল্লা ঘুরে বেড়িয়ে আসার সময় জানতে পারলাম সন্ধ্যের লাইট অ্যান্ড সাউন্ট শো-র কথা। ১ ঘণ্টার শো, প্রথমে হিন্দিতে ও পরে ইংরেজিতে। ফোর্টের সামনেই ছোট গ্যালারি৷ ৬টা বাজতেই শুরু হল শো। গ্যালারির সামনেই একটা বিরাট গাছ। সেখান থেকে কথা ভেসে এল। এক লহমায় মনে হল গাছটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, সেই যেন এই কেল্লার সব ইতিহাসের সাক্ষী। যে কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এল তা আপামর ভারতবাসীর বড্ড চেনা। স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন। এক এক করে গল্প উঠে এল ইতিহাসের পাতা থেকে। ঘটনার সঙ্গে তালে তালে আলোর বিবর্তন। যিনি এই আলোর কারুকার্য করেছেন তার নাম শুনতেই যেন বুকটা গর্বে ভরে গেল। আলোক শিল্পী তাপস সেন। কেল্লার এক একটা প্রান্তে এক একটা গল্প আর তার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে আলোর সাজসজ্জা। কেল্লাটাও যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মনে হল আমিও হয়ত বর্তমান ছাড়িয়ে সেই ইতিহাসে পৌঁছেছি। অনুভব করতে লাগলাম কেল্লার ভেতরে মানুষের চিৎকার, ঘুঙুরের আওয়াজ, বিদ্রোহ, কয়েদীদের আর্তনাদ। বারবারই শিহরণ জাগাল।

এক অসামান্য ইতিহাসকে সাক্ষী করে সেদিন ফিরে এলাম গোয়ালিয়র ফোর্ট থেকে। কিন্তু সেদিন একটা কথা মনে মনে ঠিক করে রাখলাম। ফের যদি কোনও দিন সুযোগ পাই আবার আসব এই কেল্লায়। একটা অমোঘ টান আজও আমায় টানে, সেটা হয়ত কেল্লার সেই মায়াবী হাতছানি।

সৌজন্যে : কলকাতা২৪ ডটকম