নাসরীন মুস্তাফা:


মোটকু বিটুর সঙ্গে ঝামেলা কার না হতো! সবার টিফিন জোর করে কেড়ে খেতো। কে কী ভাবলো_ তা নিয়ে একটুও ভাবতো না। ধমক খেলে দাঁত বের করে হাসতো। সেই মোটকু বিটুকে থামালো কে?

আমাদের স্কুলের ক্ষুদে বিজ্ঞানী তাপু। একটা জিপ লক ব্যাগের ভেতর বেকিং সোডা, কুসুম গরম পানি, ভিনেগার, টিস্যুর সাহায্যে ও যা করলো, তা ভাবলে আজও হাসি পায়। পেট ফোলানো ব্যাঙের সেই গল্পটার মতো ব্যাগটা ফুলে যাচ্ছিলো... বড় হচ্ছিলো... ফুলছিলো... বড় হচ্ছিলো...! মোটকু বিটুর হাতের ভেতরই ব্যাগটা ফুলতে ফুলতে সেই ব্যাঙের মতো পেট ফাটিয়ে ফেললো। ফুস! ব্যাগের ভেতরকার ভিনেগার মেশানো পানি, থুক্কু বেকিং সোডা-টিস্যু কাগজ-ভিনেগার মেশানো পানি ছিটকে গেল মোটকু বিটুর মুখে-মাথায়-স্কুল ইউনিফর্মে। এর পর থেকে ও আর কখনোই অন্যের খাবার কেড়ে খায়নি। আমিও 'কত্তো বড় লাঞ্চ ব্যাগ' নামে গল্প লিখে ঘাসফড়িংয়ের বন্ধুদের জানিয়ে দিলাম।

মোটকু বিটুকে নিয়ে আবারো ঝামেলা তৈরি হলো। ঘাসফড়িংয়ের বন্ধুরা, যথারীতি তোমাদের না জানিয়ে পারছি না ঘটনাটা।

বিটু প্রতিদিনই টিফিনে ফাস্ট ফুড আনে। স্যাররা তো বটেই, আমরাও অনেকবার বলেছি, নিয়মিত ফাস্ট ফুড খেলে নানা রকমের সমস্যা হয়। বিটু অনেক মোটকু, এটাও তো ফাস্ট ফুডের কারণেই হয়েছে। কবে যে ওকে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাবিজাবি রোগবালাই ধরে ফেলবে, সেই চিন্তায় আমরা অস্থির। ওর কিন্তু কোনো চিন্তা নেই। প্রতিদিনই মজা করে কেচাপ মাখিয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই-বার্গার-প্যাটিস খায়। আমাদের রাগানোর জন্য কেচাপ মুখে মাখিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসিও দেয়। কতোবার আর এ রকম সহ্য করা যায়, বলো?

তাপু নিজেই দাঁত কিড়মিড় করে বললো, 'কিছু একটা করতে হবে।'

'কী করবি?'

'ওর কেচাপ দিয়ে জাদু দেখালে কেমন হয়, বলো তো?'

কেমন যে হয়, তা তো নিজের চোখেই দেখলাম। বিশ্বাস করো, একটা পানিভর্তি বোতলের ভেতর কেচাপের প্যাকেটটা_ তাপুর জাদুতে একবার ডোবে, আরেকবার ভাসে। সে এক এলাহি কারবার!

এক লিটার ওজনের প্লাস্টিক বোতল, মোটকু বিটুর হাত থেকে কেড়ে নেওয়া কেচাপের মিনি প্যাকেট, পানিতে দ্রুত গলবে না এমন মোটা দানার লবণ_ ব্যস, এই তিনটে উপাদান নিয়ে তৈরি হলো তাপু। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে, ঠিক জাদুসম্রাট জুয়েল আইচের মতো করে তাকালো। বোতলের সব লেবেল তুলে ফেলে বললো, ভেতরে কী হচ্ছে দেখতে হলে লেবেল থাকলে তো চলবে না।

এরপর সেই লেবেলহীন বোতলটা কলের নিচে ধরে পানি ভরলো। পানির ভেতর লবণ মিশিয়ে এর ভেতর কেচাপের পাকেটটা ছেড়ে দিয়ে বোতলের মুখে ক্যাপ লাগালো। তারপর বোতলের দুই দিকে হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে এ রকম মন্ত্র পড়লো_

কেচাপং চাপানং

ভাসানং তুং তুং!

তাপু যখন বোতলটাকে চেপে ধরছিলো, তখন কেচাপের প্যাকেট পানির ভেতর ডুবে গেলো। হাতের চাপ সরিয়ে নিতেই প্যাকেটটা ভাসতে লাগলো। বিটু লাফিয়ে উঠলো। রেগে-মেগে বললো, 'এ রকম জাদু আমিও দেখাতে পারি।'

আরেকটা সমান আকারের বোতলের ভেতর পানি ভরে তাপুকে বললো ওর কেচাপের প্যাকেটটা ফিরিয়ে দিতে। তাপু নির্বিকার মুখে ফিরিয়ে দিলে বিটু প্যাকেটটা পানির ভেতর ছেড়ে বোতলের ক্যাপ লাগালো। তারপর হাতের চাপ দিতে দিতে আবোল-তাবোল কং বং ধরনের মন্ত্র পড়তে পড়তে বলল, দ্যাখ আমার জাদু।

আমরা দেখলাম। পানির একদম নিচে বোতলের তলানিতে শুয়ে থাকা প্যাকেটটা খুব আলসে মনে হ'ল। কিছুতেই ভাসতে চাইলো না। বিটুর হাতের চাপে বোতলটাই প্যাঁচ খেয়ে গেলো, কিন্তু কেচাপ প্যাকেটটা জাদু দেখাতে রাজি হলো না।

বিটু কাঁদ কাঁদ স্বরে জানতে চাইলো, 'এখন প্যাকেটটা কেন ভাসছে না?'

তাপু বললো, 'ওর ওজন আছে। ও কেন ভাসবে? ওজনের কারণেই স্বাভাবিকভাবে পানিতে ডুবে যাচ্ছে।'

বিটু মাথার চুল খামচে ধরে জানতে চাইলো, 'তখন কেন ভাসলো? আমি যে দিব্যি দেখলাম।'

পুরোটা তো ভালো করে দেখেনি। পানির ভেতর লবণ মেশানোর বিষয়টি ও মনোযোগ দিয়ে দেখেনি, বোঝেনি কেন লবণ দিতে হলো। বোঝেনি লবণটি কেন পানিতে দ্রুত গলে না, এমন মোটা দানার ছিল। তোমরা নিশ্চয়ই বুঝেছো?

লবণ মেশাতে মেশাতে পানির ঘনত্ব যখন বেড়ে গেলো, তখন কেচাপের প্যাকেটটা হয়ে গেলো তুলনামূলকভাবে হালকা। ভারী তরলে হালকা বস্তু ভাসবে, ভাসবেই। এ আসলে বস্তুর পানি বা কোনো তরলে ভেসে থাকার ইচ্ছে আর তরলের ঘনত্বের খেলা। পানি বা কোনো তরলে ভেসে থাকা বস্তুর এই ইচ্ছেপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় প্লবতা। ঘনত্ব ঠিক করে কোন বস্তুর মাঝে কতো পরিমাণ ভর আছে। পানিতে লবণ মেশানোর ফলে পানির ভর বেড়ে গেলো, ঘনত্বও গেলো বেড়ে। ভারী পানি কেচাপ প্যাকেটকে ভাসিয়ে রাখলো।

কেচাপ প্যাকেটের ভেতরে যে খানিকটা বাতাস থাকে, তার কথাও তো বলতে হবে। প্যাকেটের মুখ খুলে দেওয়ার সময় ফুস করে বাতাস বেরিয়ে প্যাকেট চুপসে যায়, খেয়াল করেছো? এই ইট্টুসখানি বাতাসের বুদবুদও পানিতে ভেসে থাকার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। বোতলের দুই পাশ শক্ত করে চেপে ধরলে প্যাকেটের ওপর চাপ পড়ে যায়। তখন এর ভেতরকার বুদবুদটা ছোট হতে বাধ্য হয়। ফলে প্যাকেটের ঘনত্ব পানির চেয়ে বেশি হয়ে যায়।

তাপু জানতে চাইলো, 'তখন প্যাকেটটা কী করে?'

বিটু এতক্ষণে বিষয়টা বুঝতে পেরে খুশির চোটে চেঁচিয়ে বললো, 'ডোবে।'

হাত সরিয়ে নিয়ে তাপু বললো, 'বোতলের দুই পাশে চাপ নেই। এখন কিন্তু প্যাকেটের ভেতরকার বুদবুদ আবার বড় হয়ে গেছে। ফলে প্যাকেটের ঘনত্ব গেছে পানির চেয়ে কমে। তাই এর প্লবতা বা ভেসে থাকার ইচ্ছেটাও জোরালো হয়েছে। এখন প্যাকেটটা কী করবে?'

বিটুর সঙ্গে আমরাও চেঁচালাম, 'ভাসবে!'

কেননা দিব্যি দেখলাম, প্যাকেটটা ভাসছে।