হুমায়ুন মিয়া


ত্রিশেক দশকে গণনাট্য সংঘের কর্মকান্ড যখন তুঙ্গে এবং বৃটিশ শাসন যখন ভাঙনের মুখে,ওই সময়ে একটি গান খুবই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল - 'বিচারপতি, তোমার বিচার করবে এবার এই জনতা।' এই গানটি ১৯৬৯-৭১ সালে আমাদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিত। 

ঘৃনা যখন প্রবল হয়ে উঠে তখনই এই ধরণের গানের সৃষ্টি। কবিরা বলেন, ভালোবাসার অন্য পিঠ ঘৃনা। হবে হয়তোবা। তবে ভালোবাসা যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন ঘৃণাও; কোন কোন ক্ষেত্রে তো বটেই।

কিন্ত সমস্যাটা হলো বাঙালির ভালোবাসা বা ঘৃণা কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী নয়।একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের সময়ই বলা যেতে পারে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল।অন্যকোন সময় নয়।যদি তা হত দীর্ঘস্থায়ী তাহলে ইতিহাস হত আন্যরকম। বাঙালি যেন আজ ঘৃণা করতেও ভুলে গেছে। শুধু ভালবাসা মানুষকে মানুষ করে কিনা জানিনা,তবে ঘৃণা না থাকলে সম্পূর্ন মানুষ হওয়া যায় না বলেই বুঝি।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মুজিব ফিরলেন। ভালোবাসায় ঢেকে দিতে চাইলেন সবাইকে। রাজাকাররাও ক্ষমা পেল, সব রাজাকার নয়।। হয়তো একটা পর্যায়ে চলে গেলে মানুষের আর ঘ্বৃণাবোধ থাকে না। তিনি হয়ে উঠেন অতিমানব।কিন্ত তার সেই মহানুভবতার কারণে আজ আমরা সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে।বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা প্রমান করেছে, ভালোবাসা অপাত্রে দিতে নেই। যে যে ভাষা বোঝে, তার সঙ্গে সেই ভাষাতেই কথা বলতে হয়। যে ভালোবাসা বোঝে না, তাকে অফুরন্ত ভালোবাসা দিলে কি হতে পারে চিন্তা করে দেখুন!

১৯৭১ সালে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় প্রচুর রাজাকারের সৃষ্টি হয়। কালের বিবর্তনে আর শাসক শ্রেনীর অব্যাহত ব্যর্থতায় ভাঙ্গাবাসী ওই সব রাজাকার, আর তাদের অত্যাচারের কথা ভুলে গেছে।কেবল তাই নয়,এ সব রাজাকার,বা তাদের সমর্থক অনেককেই গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মুজিব কোট পরিয়ে মুক্তিযোদ্ধায় রূপান্তর করা হয়েছে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে।পক্ষান্তরে '৭১ এর রাজাকার বা তাদের সন্তান বা তাদের সমর্থকদের একটি বড় অংশ গত সংসদ নির্বচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতি সংহত করেছে।তারা আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। কিন্ত বর্তমানে তারা বিএনপির সাথে নেই, এই কৌশলে তারা আজ বীরদর্পে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত। তাদের আস্ফালনে আমরাও আজ যেন পালিয়ে ফিরি !

কিন্ত যা'রা ৭১, ৭৫ ও ২০০১ সালে অত্যাচারিত হয়েছেন,যারা আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন,দেশ ও বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন। তাদের কেউ কেউ কাজী জাফর উল্লাহর নৌকাকে সমর্থন না করে 'আনারস' মার্কায় ভোট দিয়ে সাংসদ বানিয়েছেন; আবার কেউ কেউ নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে পরাজিত হয়েছেন। তাদের সবার কাছে '৭১ এর সব ঘৃণাই কি মনে না রেখে ভুলে যাওয়া কি সম্ভব ? জবাব কার কাছে চাইবো ? অন্তরের যন্ত্রনা কার কাছে বলবো?

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা।