চৌধুরী আ. হান্নান : ঘুষের টাকার মজাই আলাদা! কষ্ট না করে কিছু প্রাপ্তি- মন্দ কি! এক সময় ঘুষখোর কথাটা ঘৃনার উদ্রেক করতো। দুর্নীতি করে বিত্তশালী হওয়া এখন আর লজ্জার বিষয় নয়। টাকা সাদা হোক বা কালো হোক বাজারে তার ক্রয় ক্ষমতা একই। অর্থবান লোক সব সময়ই সমাজের মাথা। আইন তার পক্ষে। ঘুষের লেনদেন দেশের কোন প্রতিষ্ঠানে বেশী এটা নিয়ে বির্তক না করাই ভাল। কারণ আমরা তো ইতোমধ্যে এ বিষয়ে পৃথিবী বিখ্যাত। দেশটা আকারে ছোট হলেও অন্যদিকে বড় আছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ঘুষ বানিজ্যের টাকা ভাগ বাটোয়ারার এক চিত্র উৎসুক পাঠকের নিকট পরিবেশন করেছে গত ২৪মে এর ‘সমকাল’ পত্রিকা। পত্রিকার কল্যানে মাঝে মাঝে কিছুটা দৃশ্যমান হয়অবিরাম ঘটে চলা ঘুষ লেনদেন।

অনেক শিল্প কারখানা পন্য উৎপাদন করতে গিয়ে বর্জ নির্গমন করে পরিবেশ দূষন করে থাকে। পরিবেশ অধিদপ্তর দূষন রোধে পদক্ষেপ হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা জরিমানা করে। কয়েকদিন পর পরিবেশ মন্ত্রানালয়ের আপিল আদালত ৮০ লাখ টাকা মওকুপ করে দেয়। ঐ দিনের সমকাল পত্রিকায় এমন অনেকগুলো ঘুষ বানিজ্যের বিস্তারিত উদাহরণ রয়েছে। এমন কি আদায়কৃত জরিমানার টাকাও পরিবেশ দূষনকারী প্রতিষ্ঠানকে ফেরত দেয়া হয়েছে।

জরিমানা আরোপ হয়-জরিমানা মওকুফ হয়। সবাই তো আইন বিধি-বিধান মেনেই হয় বলে আমাদের বিশ্বাস। সম্মানিত বিচারকগণ বিচার করার সময় আইনের বই তাঁদের সামনে থাকে। তাহলে জরিমানা মওকুফের সুযোগ দিয়ে একটি চক্র কীভাবে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা? এ কালো টাকা প্রকৃতপক্ষে কোথায় কোথায় যায়তা কোন দিনই হয়ত জানা যাবে না। কোর প্রমান দেয়া সম্ভব নয় কিন্তু বিশ্বাস জম্মে যে ঐ টাকার গন্তব্য সমাজের উচু ডালে বসা গডফাদার পর্যন্ত।

এ কুকর্মে জড়িত দালালগন যাদের নাম পত্রিকায় এসেছে মূলত তারা অনুঘটকের কাজ করে থাকে। তারা আসলে ‘জজ মিয়া’ অথবা ‘নন্দঘোষ’। দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশই কৃষিজীবী, একটা বড় অংশ দেশের ভেতরে ও বিদেশে নানা পেশায় শ্রমজীবী। তাদের ঘুষ- দুর্নীতির সাথে জড়িত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বরং তারাই দেশের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহকারী। তাদের বিরতি হীন অবদানের জন্যই বাংলাদেশ এখনও সোমালিয়া,কঙ্গো, সুদানের মত অকার্যকর দেশের তালিকায় আসেনি এবং অদূর ভবিষতেও তার আশংকা নেই।

ঘুষ-দুর্নীতিতে যারা জড়িত শতকরা হিসেবে তাদের সংখ্যা খুবই ণগন্য। তারা সুন্দর চেহারার শিক্ষিত আদম সন্তান। তারা ভালছাত্র ছিল-তাই এখন অনেকেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে। এ ণগন্য সংখ্যক লোকের কার্যকলাপের জন্য বাংলাদেশ ‘বিশ্বখ্যাতি’ অর্জন করেছে।

ঘুষকে বৈধ করে দিলে একটা বড় সুবিধা আছে। তা হলো সরকার যখন এ কাজটি আইন সিদ্ধ করবে তখন ঘুষ খাওয়া আর দুর্নীতির মধ্যে পড়বে না। ঘুষকে ‘সার্ভিস চার্জ’ নাম দিয়ে কাজটা শুরু করে দেখা যায়। লেনদেনটা তখন টেবিলের নিচ দিয়ে হবে না-বাম হাতের কাজও বলা হবে না। হবে প্রকাশ্যে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাক না পাক তাতে কি! ঘুষ-দুর্নীতি তো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে। দু-কান কাটা গেলে যা হয় আর কি! ‘সার্ভিস চার্জ’ দেয়ার পর ও যখন কাজটা হবে না তখন তো অনৈতিক বা অপরাধ হিসেবে গন্য হবে।

‘আসুন আমরা সকলে মিলে ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ করি’-এমন আহ্বান অর্থহীন। কারন চোর কখনো ধর্মের বানী শুনেনি। কোন কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব যখন সকলের, তখন বুঝতে হবে এ কাজটা করার জন্য কারো দায়িত্ব নেই-বাধ্যবাধকতা নেই।

কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পৃথিবীটাকে শিশুর বাসযোগ্য করে যেতে চেয়েছিলেন। যতক্ষন দেহে প্রাণ থাকবে পৃথিবীর সকল জঞ্জাল সরাতে চেয়েছিলেন। তাঁর ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় এ ভাবেই নবজাতকের কাছে ছিল তাঁর অঙ্গীকার।

অধঃপতনের চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি জাতিকে রক্ষা করার জন্য একজন নেতা চাই-যিনি যাদুর বাঁশি বাজাবেন-আলো ছড়াবেন।

লেখক: সাবেক ব্যাংকার