শেখর রায় :


চা ওয়ালা এখন দেশের মাথা হয়েছে, আর তার জামানাতেই হচ্ছে কলকাতা চা পর্ষদ কর্মীদের সাড়ে সর্বনাশ। ৩০/৩২ বছর এক নাগাড়ে কাজ করার পর বহু কর্মচারীকে আজ ভিন রাজ্যে বদলি করা হচ্ছে। কলকাতা ব্র্যাবরন রোডের এই ঐতিহাসিক অফিসের সাথে বাংলা ও শহর কলকাতার বড় নিবিড় যোগ। এই অফিসের নামে আছে বাসস্টপেজ।

ভারতের চা শিল্পের বিকাশ হয়েছে এই অফিস কর্মীদের হাত ধরে। পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, আফ্রিকার কেনিয়া বা ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশ প্রভুত উপকৃত হয়েছে এই ভারতীয় চা পর্ষদ অফিসের দ্বারা। এই কলকাতা অফিসেরই সৃষ্টি আসাম, তামিল নাড়ু, কেরালা, দিল্লী সহ ভারতের অনেক রাজ্যের অফিস। আর আজ তার অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে। কলকাতা অফিসে কাজ করে সর্ব সাকুল্যে ২৫০ জন নানা পদে, যার চেয়ে তিন গুন বেশি মানুষ কাজ করে ভিন রাজ্যের অফিস গুলিতে। আজ শোনা যাচ্ছে যে মাত্র কয়েক ডজন কর্মী রেখে বাকি সব তাড়িয়ে দেবে কলকাতার বাইরে।

বিগত ২০১৫-১৬ অর্থ বর্ষে চা পর্ষদের সুযোগ্য নেতৃত্বে ভারতের চা উৎপাদন ৩% বেড়ে হল ১২৩৩.৪৪ মিলিয়ন কেজি এবং এই বছরে ভারত বিগত ৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে চা ভিন দেশে রপ্তানি করল ২৩২.৯২ মিলিয়ন কেজি, যার সাহায্যে দেশ ভারতীয় মুদ্রায় ৪৪৯৩.১০ হাজার কোটি রুপি বিদেশী মুদ্রা আয় করতে পারল। যে কাজের জন্য পর্ষদ কর্মীদের পুরস্কৃত করার বদলে অকারণ শাস্তি দিল এই মোদী সরকার, যা অতি দুর্ভাগ্যের। আজ পর্যন্ত পর্ষদ কর্মীদের ও পেনশনারদের জন্য ৭ম বেতন আয়োগের সুপারিশগুলি কার্যকর করা হল না, উলটে তাদের সাজানো সংসার ভেঙ্গে তছনছ করে দিল এই সরকার। আশ্চর্য হলাম যে আসাম রাজ্যের পুরানো দাবি অনুযায়ী পর্ষদের প্রধান কার্যালয় গুয়াহাটি নিয়ে যাবার অছিলায়, দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন পর্ষদের অফিসে বদলি করা হয়ে গেল। সেই নিয়ে ঝড় উঠল সংসদের দুই কক্ষে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এই একটি কেন্দ্রীয় সরকারি অফিস নিয়ে রাজনীতির খেলা খেলতে গিয়ে এবছর মুখ থুবড়ে পড়েছে চা উৎপাদন, চা রপ্তানি। কি যে অবস্থা করে ছেড়েছে এরা, বলার নয়!

চা পর্ষদ বিশেষ সংসদীয় আইনে সৃষ্টি হয়েছিল, কেন্দ্রীয় হারে বেতন কাঠামো থাকলেও ছিল এর স্বাতন্ত্র্য অস্তিত্ব। ছিল পর্ষদের নিজস্ব নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির স্বাতন্ত্র বিধি ব্যবস্থা। সব রাজ্য গুলির অফিস যে যার নিজের মত করে স্থানিয় ভিত্তিতে নিচু তলার কর্মী নিয়োগ করত, ভিন রাজ্যে বদলির কোন বিধি ছিল না, পদোন্নতির অফার ছিল স্বেচ্ছাধীন। কর্মী ইউনিয়ন ও ম্যানেজমেন্ট হাতে হাত ধরে এত দিন কাজ করে এসেছে। কোন সমস্যা হয়নি। আর আজ সব শেষ হয়ে গেছে। ডজন খানেক পিয়নকে পর্যন্ত দিল্লী বদলি করে দিয়েছে। আর প্রায় অর্ধশত কেরানিকে একই পদে তাড়িয়ে দিয়েছে ভিন রাজ্যে। বহু কর্মী সামলাতে না পেরে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে চলে গেছে। অনেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই সামান্য বেতনে কাজ করে দুটো জায়গার খরচ মেটানোর সামর্থ্য নেই কারো। তবু অনেকে বাধ্য হয়ে চলে গেছে আর চোখের জলে দিনাতিপাত করে চলেছে। আর অভিসম্পাত করছে, এই কর্মচারী বিরোধী মোদী সরকারকে। খুবই দুর্ভাগ্য আমাদের। নিন্দার কোন ভাষা নেই।

লেখক : পশ্চিম বাংলার গণমাধ্যম কর্মী ও গবেষক।