সুপ্রিয় সিকদার


সদ্য চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা অমিতাভ রেজা কতোটা সফল পরিচালক সেটা বলার অধিকার বা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই। তিনি একজন অমিতাভ রেজা যে কিনা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল, ‘শেকড়, দেশাত্মবোধ, মুক্তিযুদ্ধ, জাতি- এসব নিয়ে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি টাকার জন্য কাজ করি, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’

তিনি একজন অমিতাভ রেজা যিনি বলেছিলেন, 'আমি বাঙ্গালী মুসলমানের ফিল্ম মেকার'। যদিও পরে তিনি তার এই উক্তিটির জন্য বরাবরের মতোই সাংবাদিকদের উপর দোষারোপ করেছেন। বলেছেন, ‘ওটা ভুল ছিল। হয়তো তাদের বোঝার ভুল অথবা লেখার ভুল ছিল। সম্পূর্ণ ভুল। আমি বলেছি, আমি জাতিসত্তায় বাঙালি এবং জাতিসত্তায় একজন মুসলমান। আহমদ ছফা যে বাঙালি মুসলমানদের কথা বলেছেন, যে এলাকার কথা বলেছেন, যে জনগোষ্ঠীর কথা বলেছেন, ওই জনগোষ্ঠীর ছবি আমি বানাই। আমি বাঙালি মুসলমানের জন্য ছবি নির্মাণ করেছি- এটা ভুল কথা। এ হতেই পারে না। আমি সারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য সিনেমা নির্মাণ করেছি। সব ধর্ম, সব শ্রেণির মানুষের জন্য সিনেমা নির্মাণ করেছি।'

কিশোরগঞ্জের ছেলে অমিতাভ রেজা পরিচালিত সিনেমা 'আয়নাবাজি' ইতোমধ্যেই সুনাম কুড়িয়েছে সারা বাংলাদেশে। শুধু কি তাই, বলা যায় ব্যবসা সফল একটি সিনেমা। শোনা যায়, ৬০ লাখ টাকা বাজেটের এই সিনেমা আয়ের দিক থেকে নাকি ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সুনামের সাথে সাথে পরিচালক অমিতাভ রেজার বেফাস কথাবার্তার কারণে সিনেমাটি বেশ আলোচিত-সমালোচিত।

আমার কাছে মনে হয়েছে, অমিতাভ রেজা খুব ভালো করে ব্রান্ডিং বোঝেন। বোঝেন কিভাবে নিজেকে আলোচিত বা সমালোচিত রাখা যায়। বেফাস কথাবার্তা বলাও আমার কাছে অমিতাভ রেজার চালাকি বলেই মনে হয়েছে। বেফাস কথা বলে যে আলোচিত বা সমালোচিত থাকা যায় সেটা আমরা ফাঁসি কার্যকর হওয়া যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দেখেই শিখেছি। বলা যেতেই পারে এটা অমিতাভ রেজার ভালো একটা দিক। যেভাবেই হোকে আলোচনায় বা সমালোচনায় তিনি বা তার প্রথম পরিচালিত সিনেমা 'আয়নাবাজি' রয়েছেই।

২০০৬ সালে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘মনপুরা’ সিনেমার প্রায় দীর্ঘ ১০ বছর পর ২০১৬ সালেই আয়নাবাজিই পেরেছে দর্শককে সিনেমা হল মুখি করতে। আয়নাবাজির প্রচারণাও ছিল চোখে দেখার মতো। ভাবা যায়, ৩০ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি ২৫/২৬ অক্টোবর, প্রায় একমাস ধরে বুক ফুলিয়ে চলেছে দেশের প্রায় ৭০টি সিনেমা হলে। ২/৩ দিন আগে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে দেখতে হয়েছে সিনেমাটি। সিনেমা প্রেমীরা ব্ল্যাকে টিকেট কেটেও দেখেছিল এই আয়নাবাজি। আশা দেখেছিল ব্যবসায় ধ্বস নামা সিনেমা হলের মালিকেরা, আশা করেছিল বাংলাদেশের সকল সিনেমা প্রেমী, সকল বয়সের মানুষ, যে এবার বাংলা সিনেমা হলে গিয়েই দেখতে পারবো আমরা। কিন্তু সে আশা দেখিয়েও আশাপূরণ করতে পারলো না আয়নাবাজি... দর্শককে সিনেমা হলে ধরে রাখতে পারলো না আয়নাবাজি। দর্শক এখন আয়নাবাজি দেখেন ৫ ইঞ্চির মোবাইল ফোন আর ১৫ ইঞ্চির কম্পিউটার মনিটরে।

পাইরেসি, এই শব্দটা আয়নাবাজির সিনেমাটির সাথে একদমই যায় না! যদি পাইরেসি শব্দটি আয়নাবাজি সিনেমাটির সাথে যায় তাহলে এই পাইরেসির জন্য টিম আয়নাবাজি নিজেই দায়ী। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া বাঙ্গালীকে কি এখনো বোকা মনে করে টিম আয়নাবাজি ?? মাত্র একদিনে ৫০ লাখ টাকা আয়ের জন্যই টেলিকম কোম্পানি রবির কাছে আয়নাবাজি বিক্রি করে তারা। একজন রবি গ্রাহক মাত্র ৩৬ টাকা দিয়ে সিনেমাটি দেখতে পারবে, প্রচার হবে, দর্শক বাড়বে সে আশায়। কিন্তু ফলাফল, কেউই আর টাকা খরচ করে না আয়নাবাজির জন্য। একটু খোঁজ করলেই ফেসবুক, ইউটিউব আর নানান ভিডিও সাইটে পাওয়া যাচ্ছে আয়নাবাজি সিনেমা, এমনকি পাড়ার ফটোকপির দোকানেও সাইনবোর্ড টানিয়ে বিক্রি হচ্ছে আয়নাবাজি। নামে মাত্র ৫ টাকা বা ১০ টাকায়!

টিম আয়নাবাজি, আপনাদের দরকার ছিল না রবির কাছে সিনেমাটি বিক্রি করা। আমরা হলে যেয়েই দেখতাম অমিতাভ রেজার প্রথম সিনেমা। যতোই রাগ থাকুক অমিতাভ রেজার ওপর, তার অনবদ্য সৃষ্টি আমরা ব্ল্যাকে টিকেট কেটেই দেখতে পারতাম। এভাবে একটি সম্ভাবনা নষ্ট করার অধিকার আপনাদের নেই। পাইরেসির জন্য আপনাদের বিরুদ্ধেই সবার আগে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

এবার আসি, মৌলিকতা নিয়ে। আয়নাবাজি মৌলিক সিনেমা, বলেছেন অমিতাভ রেজা নিজেই। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সমালোচনা হচ্ছে যে আয়নাবাজি একটি কোরিয়ান সিনেমা 'টাম্বেলইড' থেকে চরিত্র চুরি করে নিয়ে বানানো হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, অমিতাভ রেজা যেহেতু কোরিয়ান সিনেমার কোন ক্রেডিট কোথাও দেয়নি সেহেতু এটা সত্যই 'চুরি'।

যদি তাই হয়, তাহলে বলতেই হয়, অমিতাভ রেজা আপনি সত্যি একজন শেকড়, দেশাত্মবোধ, মুক্তিযুদ্ধ, জাতি বহির্ভূত মানুষ বা অন্যকিছু।