নাগরপুর ( টাংগাইল) প্রতিনিধি : পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এলাকা টাংগাইলের সর্ব দক্ষিণের উপজেলা নাগরপুর। তিন দিকে নদী বেস্টিত সবুজ ও নির্মল প্রকৃতি, ঐতিহাসিক স্থাপত্যের পসরা সাজিয়েছে নাগরপুর উপজেলা। উপজেলায় ছড়িয়ে আছে নানান ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য। এসব ইতিহাস ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের যোগাবে নানা কৌতুহলের রসদ।

টাংগাইলকে বলা হয় জমিদারদের নগরী। সেই টাংগাইল থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দুরত্বের দক্ষিণের উপজেলা নাগরপুর। এখানে রয়েছে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মত নানান দর্শনীয় স্থান। উপজেলার অভ্যন্তরে নাগরপুর জমিদার বাড়ি, উপেন্দ্র সরোবর( দিঘী),পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি, উদয়তারা সমাধিসৌধ( মঠ),শতবর্ষী পুরাতন বিদ্যালয়, হাসপাতাল, মন্দির -এসব নাগরপুরকে সমৃদ্ধ করেছে পর্যটন নগরী হিসেবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এবং নিবিড় শান্তিময় পরিবেশের নাগরপুর উপজেলা আয়তনের দিক দিয়ে ছোট হলেও প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাসে সমৃদ্ধ। এ উপজেলার তিন দিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে ঢাকা,মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের তিন উপজেলা। যমুনা, ধলেশ্বরীর মতো নদী এ উপজেলাকে চতুর্দিকে ঘিরে রেখেছে।

নাগরপুর জমিদারবাড়ি : উপজেলা সদরেই রয়েছে প্রায় দেড়শ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়ি। স্থানীয়ভাবে এটি চৌধুরিবাড়ি নামে পরিচিত। নাগরপুরের তৎকালীন জমিদার রায় বাহাদুর সতীশ চৌধুরি ৫৪ একর জায়গায় এ জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর এ বাড়ি থেকেই তিনি শাসন কাজ পরিচালনা করতেন। এ জমিদারবাড়িতে রয়েছে অপূর্ব কারুকাজ করা বিশাল ভবন। ভবনের দেয়ালের প্রতিটি পরতে পরতে সৌন্দর্য্যরে ছোঁয়া এবং ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী বহন করে দাড়িয়ে আছে ভবনগুলো। অন্যান্য জমিদারবাড়ির চেয়ে একটু হলেও বাড়তি সৌন্দর্য্য খুজে পাওয়া যাবে এই জমিদারবাড়িতে। এখানে পাশাপাশি কয়েকটি ভবন রয়েছে প্রতিটি ভবনই চমৎকার কারুকার্যমন্ডিত। একত্রে এতগুলো ঐতিহাসিক ভবন পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষন করবে নিঃসন্দেহে। শৈল্পিক কারুকার্যমন্ডিত এই বাড়ির ভিতরেই আছে পরীর দালান। জমিদার সহ তার পরিবারের সদস্যদের চিত্তবিনোদনের জন্য এই দালানের ভিতরে ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। নাচ- গান চলত এখানে। পরীর মত সুন্দরী নারীরা এখানে নাচার কারনেই ভবনটির নাম পরীর দালান হয়েছে বলে কথিত আছে। এ জমিদারবাড়ির পশ্চিম পাশে রয়েছে ঘোড়ার দালান। তিন তলা বিশিষ্ট এই ঘোড়ার দালানের মূল ফটকের উপরে রয়েছে বিশাল আকৃতির দুটি ঘোড়ার মূর্তি। জমিদারদের ব্যবহৃত ঘোড়াগুলো এখানেই রাখা হত।

পুন্ডরীকাক্ষ চিকিৎসালয় : কথিত আছে জমিদারি আমলে জুতা পরে ও ছাতা মাথায় দিয়ে জমিদার বাড়ির পাশ দিয়ে কেউ যেতে পারত না। তারপরেও প্রজা-হিতৈষী এই জমিদার এলাকায় স্কুল, কলেজ, দাতব্যচিকিৎসালয়, হাটবাজার,দিঘী প্রতিষ্ঠা করেন। এই অঞ্চলের লাখো মানুষের অসুখের কথা চিন্তা করে তারা সেসময় এখানে পুন্ডরীকাক্ষ দাতব্যচিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা আজ নাগরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে ঠায় দাড়িয়ে আছে। পর্যটকরা এর নির্মাণ শৈলী দেখলে বুজতে পারবে সে আমলে কিভাবে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হত।

উপেন্দ্র সরোবর ( দিঘী) : জমিদার বাড়ি থেকে একটু অদূরে প্রজাদের জলের অভাব পুরনের জন্য ১১একর জমির উপর খনন করা হয়েছিল বিশাল আকৃতির জলাশয়। জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা রায় বাহাদুরের বাবার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল উপেন্দ্র সরোবর। কিন্তু স্থানীয়ভাবে এটি দিঘী নামে পরিচিত। প্রথমদিকে শিবচতুর্দশীতে এখানে শিবের মেলা বসত। বর্তমানে দিঘীর চারপাশে গাছ লাগানো হয়েছে। পর্যটকদের বসার জন্য সানশেড,বসার বেঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। দিঘীর ১২টি সান বাধানো ঘাটে বসে আপনি হারিয়ে যেতে পারেন প্রকৃতির মাঝে। দিঘীর টলমল জলে বিভিন্ন পাখির জলকেলি দেখে ও এর নির্মল বাতাস যে কোন পর্যটকের মন ভরিয়ে দেবে।

পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি : নাগরপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার পূর্বে ধলেশ্বরী নদীর ধারে অবস্থান পাকুটিয়া জমিদারবাড়ির। পাকুটিয়ার তৎকালীন জমিদার বৃন্দাবন চন্দ্র রাধা গোবিন্দ ১৯১৫ সালে ২৪ একর জায়গার উপর এই জমিদারবাড়িটি তৈরি করেন। জনশ্রুতি আছে জমিদার বৃন্দাবনের ৩ ছেলের জন্য তিনটি ভবন তৈরি করেন। ভারত থেকে নদীপথে এর নির্মাণ সামগ্রী ও শ্রমিক এনে এ ভবনগুলো তৈরি করা হয়েছে। সৌন্দর্য ও শৈল্পিকতার বিচারে নাগরপুর জমিদারবাড়ির চেয়ে কোন অংশে কম যায় না এই জমিদারবাড়ি। অপূর্ব কারুকার্য মন্ডিত এ জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখলে যে কারো মন ভরে উঠবে। এর সান বাধাঁনো পুকুরঘাট,নাটক ও বাইজীদের নাচের জন্য সুবিশাল নাট্যমন্দির পর্যটকদের মন ভরিয়ে তুলবে।

উদয়তারা সমাধি সৌধ : নাগরপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত উদয়তারা সমাধি সৌধ যা স্থানীয়ভাবে গয়হাটার মঠ নামে পরিচিত। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে তৎকালীন জমিদার কালি কুমার চৌধুরি তার মায়ের সমাধির উপর নির্মাণ করেন এই সৌধ। তার মা উদয়তারা চৌধুরির স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য প্রায় তিন'শ ফুট লম্বা এই ঐতিহাসিক সমাধি সৌধটি নির্মাণ করেন তিনি। সংরক্ষনের অভাবে এর ভিতরে অবস্থিত শিবলিঙ্গ,পিতলের তৈরি বিভিন্ন মুর্তি চুরি হয়ে গেছে। আর প্রকৃতিক দুর্যোগের কারনে এর উপরের কিছু অংশ ভেঙ্গে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সমাধি সৌধটি অষ্টাদশ শতকে স্থপত্যের একটি চমৎকার নিদর্শন। এর স্থপত্য কৌশল ও দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ দর্শনার্থিদেও আকর্ষণ করে।

নাগরপুরে বেড়াতে আসলে খানকটা সময়ের জন্য হলেও আপনি হারিয়ে যেতে পারেন অতীতে। হয়ত চোখের সামনে ভেসে উঠবে আগের জমিদার বাড়ির কোলাহল। এছাড়া ধলেশ্বরী নদীর উপর নির্মিত দুটি সেতু নদীর ধারের কাশফুল, জেলেদের নৌকা নিয়ে মাছ ধরার অপরুপ দৃশ্য এ সবই পর্যটকদের মনকে ভরিয়ে তুলবে।

(আরএসআর/এএস/নভেম্বর ০২, ২০১৬)