বান্দরবান প্রতিনিধি : পার্বত্য বান্দরবানে বর্ণাঢ্য আয়োজনে আগামী ১৩ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে পাহাড়ীদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বৈসাবী। পাহাড়ী সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও সামাজিকতাকে ধারণ করে পৃথকভাবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উদযাপন করে আসছে আদিকাল থেকে। যা দীর্ঘদিন ধরে বৈসাবী হিসেবে পালিত হয়ে আসছে তিন পার্বত্য জেলায়।

পাহাড়ীদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবী শব্দকে ঘিরে নানা মত পার্থক্য থাকলেও প্রতিটি সম্প্রদায় আনন্দঘন পরিবেশে নিজস্ব সংস্কৃতি দিয়ে বর্ষবরণ করে থাকে। বর্ষবরণের এই রীতি পাহাড়ীদের মধ্যে মূলত ৪টি সম্প্রদায়ের ঘটা করে ঐতিহ্যগতভাবে পালন করে। ত্রিপুরা ও তংচংঙ্গ্যা সম্প্রদায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে বলেন বৈসু, মারমা সম্প্রদায় বলেন সাংগ্রাই এবং চাকমারা বলেন বীজু। এই ৪ সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বৈসু, সাংগ্রাই ও বীজু’র প্রথমাক্ষর দিয়ে সমষ্টিগতভাবে বৈসাবী হিসেবে পালন করা হয়। পাহাড়ীদের সব চেয়ে বড় সামাজিক উৎসব বৈসাবীকে ঘিরে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় চলছে প্রস্তুতির ধুম। বছরের প্রথমদিন নতুন কাপড়ে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে ইতোমধ্যে স্থানীয় বাজার গুলোতে নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণীরা ভিড় জমিয়েছে। দাম কোন বিষয় নয়, চাই নতুন পোশাক। বছরের এই একটিদিন ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দাম হাঁকিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রদায় ভিত্তিক পাহাড়ী পল্লী গুলো নতুন বছরকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত। চাকমা, ত্রিপুরা এবং তংচংঙ্গ্যা সম্প্রদায় বৈসু ও বীজুর প্রথম প্রহরে আগামী দিনগুলো যাতে ফুলের মতো সুন্দর হয় সে জন্য নদীতে ফুল উৎসর্গ করে পূজা অর্চনা করেন। বৌদ্ধ বিহারে দান-দক্ষিনার মাধ্যমে নিজেকে পাপাচার মুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকেন। প্রতিটি পল্লীতে নিজস্ব আদলে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে থাকেন। তবে তাদের প্রধান আকর্ষণ ঘিলা খেলা। নারী-পুরুষ আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই এই খেলায় অংশগ্রহণ করেন। ১৩ এপ্রিল বিকেল ৫টা থেকে ২দিন ব্যাপী ঘিলা খেলা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে রেইচা তংচংঙ্গ্যা পাড়ায়।
পাহাড়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে বান্দরবান জেলার মারমা সম্প্রদায় ৫ দিন ব্যাপী জাকজমকপূর্ণ আনুষ্ঠনিকতার মাধ্যমে উৎসব মুখর পবিবেশে সাংগ্রাই উৎসব পালন করেন।

সাংগ্রাই উৎসব কমিটির সভাপতি অং চ মং মারমা জানান, মুল অনুষ্ঠান ৫দিনের। ১৩ এপ্রিল সাংগ্রাই র‌্যালীর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। দুপুরে পুজনীয় বয়স্কদের শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুজার্চনা এবং চিত্রাংকণ প্রতিযোগিতা। ১৪ এপ্রিল বিকেল ৩টায় বুদ্ধ মূর্তি স্নান। এই অনুষ্ঠানে সকল বয়সের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ অংশ নেয়। সকলের হাতে চন্দন কাঠের পানি ও কাঁচা দুধ দিয়ে সাঙ্গু নদীর তীরে বুদ্ধ মূর্তিকে স্নান করান। বুদ্ধ মূর্তি স্নানের পানি নিজ পত্রে নিয়ে ঘরে ফিরেন তারা। তাদের অমীয় বিশ্বাস বুদ্ধ মূর্তি স্নানের পানি পান করলে কঠিন রোগসহ নানা বালা মুসিবত দুর হয়। ঐ দিন রাত ১০টায় উজানী পাড়া, মধ্যম পাড়া ও জাদি পাড়ায় আনুষ্ঠানিক ভাবে পিঠা তৈরির উৎসব শুরু হবে। ১৫ এপ্রিল পুরাতন রাজবাড়ী মাঠে বিকেল ৩টায় ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী পানি বর্ষণ এবং রাতে পিঠা তৈরির উৎসব। ১৬ এপ্রিল মৈত্রী পানি বর্ষণের সমাপনি ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সর্বশেষ ১৮ এপ্রিল দিনব্যাপী রাজগুরু বৌদ্ধ বিহারে ধর্মনির্দেশনা শ্রবণ ও সেমিনার।
বান্দরবানের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আকর্ষণ বুদ্ধ মূর্তি স্নান ও মৈত্রী পানি বর্ষণ। মারমা সম্প্রদায়েরা মনে করেন একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে পুরাতন বছরের সকল দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি ধুয়ে মুছে বিদায় এবং নতুন বছরকে আনন্দের মধ্য দিয়ে আলিঙ্গন করে বরণ করার জন্য মৈত্রীময় পানি বর্ষণ।
(এএফবি/এএস/এপ্রিল ০৯, ২০১৪)