শামীম হাসান মিলন, চাটমোহর (পাবনা): আবহমান গ্রামবাংলার উৎসবের ঋতু শীত। নবান্নের আগে-পরে চিরাচরিত উৎসব হয় নানারকম। উৎসব প্রিয় বাঙালি মেতে ওঠেন নানা আয়োজনে। তেমনি একটি ব্যতিক্রমী উৎসব হচ্ছে মাছ শিকার করতে পলো বাওয়া উৎসব।

নবান্নের শুরুতে যার দেখা মেলে দেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল অঞ্চলে। হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে বিলে নেমে পলো দিয়ে মাছ ধরার আয়োজনকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছেন বাউত উৎসব। গ্রামীন এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে খাল-বিল-জলাশয়ে মাছের অভয়ারণ্য গড়ে তোলার দাবি চলনবিলবাসীর।

বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলনবিল অধ্যুষিত চাটমোহর উপজেলার খলিশাগাড়ি বিলে পলো বাওয়া বাউত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। পলো দিয়ে যারা বিলে মাছ ধরেন তাদেরকে বাউত বলা হয়। প্রতিবছর এসময় এ এলাকার মানুষেরা পলো দিয়ে বিলে উৎসবমুখর পরিবেশে মাছ ধরেন বলে এ উৎসবকে স্থানীয় ভাষায় বাউত উৎসব বলা হয়। বুধবার পাবনার চাটমোহর, আটঘরিয়া, পাবনা সদর, বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর এলাকার শত শত বাউত উৎসবে যোগ দেন।

ভোর বেলা থেকে শুরু করে সকাল নয়টা পর্যন্ত দুর-দুরান্ত থেকে নছিমন, করিমন, অটোভ্যান, মোটর সাইকেল, বাই সাইকেলে আবার কেউবা পায়ে হেঁটে রওনা হন বিলের উদ্দেশ্যে। তাদের হাতে ছিল পলো, চাক পলো, নেট পলো, ঠেলা জাল, বাদাই জাল, লাঠি জালসহ মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম। বিলপাড়ে সমবেত হওয়ার পর একসাথে বিলে নেমে মাছ ধরার আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেন শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সহ নানা বয়স শ্রেণি পেশার মানুষ।

সরেজমিন দেখা যায়, বিল থেকে বর্ষার পানি প্রায় নিঃশেষ হবার পথে। মূল বিল, খালে কিছু অবশিষ্ট পানি রয়েছে। উজানের বিলগুলো থেকে কিছু পানি এ খাল বেয়ে পরছে গুমানী নদীতে। এমন সময় এ এলাকার উৎসব প্রিয় মানুষেরা যোগ দিয়েছেন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবে। মাছ পাওয়া না পাওয়া তাদের কাছে বড় কথা নয়, ব্যতিক্রমী এ উৎসবে যোগ দিয়ে আনন্দ উপভোগই যেন তাদের কাছে মুখ্য। তবে অনেকেই বোয়াল রুই কাতলা শোল মাছ শিকার করে বাড়ি ফিরেছেন আনন্দের সাথে।

বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি এক একটি পলোর উচ্চতা প্রায় তিন ফিটের মতো। শখের বশে অনেকে পলোতে শৈল্পিক কারুকার্য করিয়ে নিয়েছেন।

এ উৎসবে যোগ দিতে আসা পাবনার মামুদপুর গ্রামের মোজাহার আলী, চাটমোহরের দাঁথিয়া গ্রামের এনামুল হক, বোয়ালমারী গ্রামের আনিসুর রহমান ও বেলাল হোসেনসহ অন্যান্য বাউতরা জানান, হাজার হাজার মানুষ একসাথে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। মাছ সবাই পায় না। একজন পেলে আনন্দ ভাগাভাগি করেন সবাই। কে মাছ পেলো আর কে পেলো না তা নিয়ে দু:খ নেই কারো। প্রতি বছর আনন্দের জন্য, মাছ ধরার জন্য এই সময়টার অপেক্ষায় থাকেন তারা।

এ ব্যাপারে চাটমোহরে কর্মরত উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, বাউত উৎসব গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। দেশের অন্যান্য এলাকায় এ উৎসব প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে এ এলাকায় ঐতিহ্যটি এখনো টিকে আছে। বড় বিল, ডেঙ্গার বিল, খলিশাগাড়ি বিল, রহুল বিল, ডিকশীবিলসহ অন্যান্য বিলে বাউতরা মাছ ধরছে। তবে বাউত উৎসবের ফলে জীব বৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে। দেশী প্রজাতির ছোট মাছ, শ্যাওলা জাতীয় প্রাকৃতিক মৎস্য খাদ্য, পানির উপকারী অনুজীব নষ্ট হয়ে যায়।



(এসএইচএম/এস/নভেম্বর ২৪, ২০১৬)