মাঈনুল ইসলাম নাসিম : মাত্র দু’জন অফিসার নিয়েই দু’বছর ধরে চলছে বিশাল দেশ ব্রাজিলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ দূতাবাসের কার্যক্রম। ২০১২ সালের জুনে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাষ্ট্রদূতের সাথে মাত্র ১ জন সেকেন্ড সেক্রেটারি নিযুক্ত আছেন দক্ষিণ আমেরিকার অর্থনৈতিক পরাশক্তি দেশের রাজধানীতে। ব্রাজিলীয় নাগরিক হিসেবে একমাত্র ব্যক্তি যিনি কর্মরত আছেন টেলিফোন অপারেটর হিসেবে, তাকে পেতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় দূতাবাসের।

ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকার সমন্বয়ে গড়া আন্তঃমহাদেশীয় অর্থনৈতিক ফোরাম BRICS (ব্রিক্স)-এর অন্যতম দেশ ব্রাজিল। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার বাংলাদেশির বসবাস। বিগত বছরগুলোতে ভিন্নপথে তাদের এদেশে আগমন হলেও আসছে দিনগুলোতে বাংলাদেশি বৈধ জনশক্তির অপার সম্ভাবনার দুয়ার এই ব্রাজিল। RMG তথা বাংলাদেশের গার্মেন্টসের চমৎকার বাজার ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এখানে। বাংলাদেশ মেইড টি-শার্ট, শর্ট-পেন্ট সহ আরো বেশ কিছু আইটেমের ব্যাপক চাহিদা ব্রাজিলের বাজারে।

পাশের দেশ চিলি-বলিভিয়ার মতো ব্রাজিলেও বাংলাদেশ মেইড মেডিসিনের লাভজনক বাজার সৃষ্টি হওয়া এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সয়াবিন রফতানিকারক দেশ ব্রাজিল। গত সেশনে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে শীর্ষে চলে আসে দেশটি। ব্রাজিলীয় সয়াবিন বাংলাদেশেও যাচ্ছে, তবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আরো বেশি চোখ-কান খুলে এগুলে অনেক বেশি লাভবান হবেন, একথা তারাও ভালো জানেন। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশ ব্রাজিল। বিশ্বে সর্বাধিক ব্যবহৃত ধাতুর মধ্যে কপারের স্থান তিন নম্বরে। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ব্রাজিলীয় কপার রফতানী হচ্ছে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, যা কাজে লাগানো হয় আধুনিক শিল্পকারখানাগুলোতে।

ব্রাজিল-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক সম্পর্কে নবদিগন্তের সূচনা করতে হলে বাংলাদেশ সরকারের নড়েচড়ে বসার সময় এসেছে আজ। হাই প্রোফাইল ডিপ্লোমেট এম শামীম আহসান রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে আছেন দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। ছাত্রজীবনে প্রখর মেধাবী এই কূটনীতিক ২০১২ সালে ঐসময় ব্রাসিলিয়ায় সদ্যপ্রতিষ্ঠিত দূতাবাসে যোগ দেয়ার আগে ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ব্রুনেই দারুসসালামে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ২৭ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে নতুন দিল্লী, জেনেভা, কুয়ালালামপুর ও নিউ ইয়র্কে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন ছাড়াও ঢাকায় ‘চিফ অব প্রটোকল’ এবং পররাষ্ট্র দফতরে বিভিন্ন উচ্চপদে সাফল্যের পরিচয় দেন তিনি।

১৩ জুন শুক্রবার এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে রাষ্ট্রদূত এম শামীম আহসান বলেন, ‘‘অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে গত দু’বছর আমাদের কাজ করে আসতে হয়েছে। ব্রাজিল এমন একটি দেশ যেখানে অফিস-আদালতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন নেই বললেই চলে। বিশাল আয়তনের অপার সম্ভাবনার এই দেশে দূতাবাসের কর্মপরিধি বিস্তৃত করতে আমাদেরকে বেশ খানিকটা সময় নিতে হয়েছে এবং হচ্ছে, তবে সাফল্যের পথেই আমরা হাঁটছি।’’ ব্রাজিল জুড়ে বাংলাদেশি পন্যের অবাধ বাজার নিশ্চিত করতে তথা বড় বড় অর্ডার পাইয়ে দিতে রাষ্ট্রদূত এম শামীম আহসান নিজেই সশরীরে ঘুরে বেড়িয়েছেন বানিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলোর বিভিন্ন রিটেইল শপ সহ অন্যত্র বহু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে। ব্যাপক গ্রাউন্ডওয়ার্ক পরবর্তী আজ ব্রাজিল জুড়ে বাংলাদেশি পন্যের যে বাজার সৃষ্টি হয়েছে, তার কৃতিত্বের সিংহভাগ রাষ্ট্রদূত এম শামীম আহসানের।

চলমান বিশ্বকাপকে ঘিরে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ জোয়ারেও নিজের মেধা ও কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়েছেন সাফল্যের সাথে। আরএমজি সেক্টরের এই অর্জনকে দূতাবাসের তথা নিজের অ্যাচিভমেন্ট মনে করেন কিনা জানতে চাইলে অনেকটাই প্রচারবিমুখ এই পেশাদার কূটনীতিক বললেন, ‘‘আসলে আমি বিষয়টিকে ঠিক সেভাবে বলতে চাই না, তবে মূল কথা হচ্ছে আমরা কাজ করে যাচ্ছি এবং সুফলও পাচ্ছি।’’ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ব্রাজিলের মতো দেশে একজন কমার্শিয়াল কাউন্সিলর প্রয়োজন ছিলো কিনা জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত এম শামীম আহসান বলেন, ‘‘ঢাকা থেকে শুধু অফিসার পাঠালেইতো হবে না, এখানে সফল হতে হলে পর্তুগীজ ভাষায় মিনিমাম দক্ষতা নিয়েই কারো আসা উচিত।’’

রাষ্ট্রদূতের সাথে ব্রাসিলিয়াতে একমাত্র অফিসার হিসেবে আছেন সেকেন্ড সেক্রেটারি আলাউদ্দিন ভুইয়া। পরিশ্রমী এই তরুণ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, ‘‘দু’বছর আগে দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ৯ মাস রাজধানীর একটি হোটেল কক্ষ থেকেই দূতাবাসের কার্যক্রম আমাদের চালাতে হয়েছে।’’ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি পরবর্তী ঢাকার ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় সুমন সাহার একটি বিশেষ প্রতিবেদন পর্তুগীজ ভাষায় অনুবাদ করে সাও পাওলার প্রভাবশালী পত্রিকায় সাম্প্রতিককালে ফলাও করে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয় বলে জানান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব।

সর্বোপরি যে সুদূরপ্রসারী টার্গেট নিয়ে ব্রাজিলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ দূতাবাস, তা পূরণে ‘টিম ওয়ার্ক’ সুনিশ্চিত করতে হলে যত দ্রুত সম্ভব ব্রাসিলিয়াতে ১ জন করে কাউন্সিলর, ফার্স্ট সেক্রেটারি ও কমার্শিয়াল কাউন্সিলর নিয়োগ দেয়া অত্যাবশ্যক বলে মনে করছেন বিশ্লেষক মহল। উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রাজিল-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক সম্পর্কন্নোয়নে ব্রাসিলিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস তথা বাংলাদেশ সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে বানিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলাতে সাম্প্রতিককালে যাত্রা শুরু করেছে ব্রাজিল-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম (বিবিবিএফ)। সাও পাওলোর প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ব্যবসায়ী এস এম মুস্তাফিজুর রহমান অনিকের নেতৃত্বে এবং বেশ ক’জন প্রভাবশালী ব্রাজিলীয় ব্যবসায়ী, অধ্যাপক, সাংবাদিক ও আইনজীবির সমন্বয়ে বিবিবিএফ ইতিমধ্যে সাও পাওলো চেম্বার সহ ব্রাজিলীয় প্রশাসনের সাথে নিবিড় নেটওয়ার্কের ভিত্তিতে কাজও শুরু করেছে।
(এএস/জুন ১৪, ২০১৪)