কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বাল্যবিয়ে, এলাকা ভিত্তিক বখাটেদের উপদ্রপ, দারিদ্র ও সচেতনতার অভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের ঝরে পড়া হঠাৎ বেড়ে গেছে। সেই সাথে শিক্ষকদের টাকার বিনিময়ে কোচিং ক্লাস বাধ্যতামূলক করা এবং শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোযোগ আন্তরিকতার অভাবে সমুদ্র উপকূলীয় এ উপজেলায় সরকারের সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মক ব্যহত হচ্ছে। এ বছর অনুষ্ঠিত জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় কলাপাড়ার ১৬ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ১২ টি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বিশ্লেষন ও সরেজমিন অনুসন্ধান করে এ চিত্র পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ বছল উপজেলার ২৮ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুই হাজার ৫৭৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০৩ শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণিতেই ঝরে পড়ে। যার গড় হার ১১ দশমিক ৭৭ ভাগ। ১৬ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে এক হাজার আটশ ১৭ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। এরমধ্যে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় এক হাজার ছয়শ ৭১ জন। এক বছরে মাধ্যমিক স্তরে ঝরে গেছে ১৪৬ জন। যার মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যাই বেশি। তবে মাদ্রাসা স্তরে ঝরে পড়ার হার ২৬ দশমিক ১২ ভাগ।

উপজেলার আশ্রাফ একাডেমি থেকে ১৬২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পরীক্ষা দিয়েছে ১২৬ জন। অনুপস্থিত ৩৬ জন। বেতমোর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরীক্ষায় ৬৯ জন শিক্ষার্থী রেজিষ্ট্রেশন করলেও পরীক্ষা দিয়েছে ৫১ জন। অনুপস্থিত ১৮ জন। মহিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২৯০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পরীক্ষায় উপস্থিত পাওয়া গেছে ২৬৫ জন। অনুপস্থিত ২৫ জন। পাখিমারা প্রফুল্ল মনো ভৌমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৯৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে অনুপস্থিত ৪ জন, খেপুপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৪২ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ১২৮ জন। অনুপস্থিত ১৪ জন। লোন্দা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬৬ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৫৬ জন। অনুপস্থিত ১০ জন।

রজপাড়া দ্বীন-ই-এলাহি মাদারাসায় অষ্টম শ্রেণিতে ৮৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নেয় ৭৬ জন। মোয়াজ্জেমপুর মাদ্রাসায় ৬৬ জনের পরীক্ষায় অংশ নেয় ৫২ জন। মুসল্লিয়াবাদ মাদ্রাসায় ১০২ জনের মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৮৬ জন। ইউসুফপুর বালিকা দাখিল মাদ্রাসায় ৬১ জনে ৪৭ জন। আক্কেলপুর মাদ্রাসায় ৬০ জনে ৩৭ জন। উপজেলার ১২টি মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৫৮ জন। কিন্তু জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ৬০১ জন। ঝরে পরেছে ১৫৭ জন।

ফরিদগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতেমা, কুলসুম, রিতা ও বিউটির এ বছর জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করলেও বাল্যবিয়ের কারনে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ। আর্থিক সমস্যার কারণে এ বিদ্যালয়ের ছাত্র খায়রুল অষ্টম শ্রেনিতে উর্ত্তীর্ণ হওয়ার পর আর পরীক্ষার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করতে পারেনি। বর্তমানে সে ঢাকায় শ্রমবিক্রির কাজ করে। এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানালেন শুধু বাল্যবিয়ের কারনে তার বিদ্যালয়ের চার ছাত্রীর শিক্ষাজীবন শেষ।

বখাটেদের উপদ্রবের কারনে শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয়েছে পাখিমারা প্রফুল মনো ভৌমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী স্বর্না হাওলাদারের। সন্মান বাঁচাতে আট মাস আগে তার বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে পরিবার।

মুসল্লীয়াবাদ মাদ্রাসার এক শিক্ষক জানান, গ্রামবাসীর সঞায়তার মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মাজেদা বেগমের বাল্য বিয়ে বন্ধ করতেক পারলেও তার শিক্ষাজীবন রক্ষা করতে পারেন নি। পরিবারের অসচেতনতায় তার এখন লেখাপড়া বন্ধ। ধানখালী মহিলা দাখিল মাদ্রাসার সুপার জানান, তার মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছয় ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। কুয়াকাটা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার জানান, তার অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী আজমইন দারিদ্র্যের কারনে পরীক্ষা দিচ্ছে না।

একাধিক অভিভাবক জানান, লেখাপড়া এখন বড়লোকের জন্য। স্কুলে কোচিং না করলে শিক্ষকরা পরীক্ষায় মার্কস দেয় না। প্রাইভেট না পড়লে গরীব শিক্ষার্থীদের প্রতি নজর দেয় না। তাই আর্থিক সংকটে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।
একাধিক শিক্ষক জানান, শহরের চেয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় এ ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। তবে এর কারন হিসেবে গ্রামীন জনপদে মেয়েদের স্কুৃল-মাদ্রাসায় যেতে নানা প্রতিবন্ধকতা ও বখাটেদের হয়রানী সহ্য করতে হওয়ায় অভিভাবকরা স্কুলের পাঠ চুকিয়ে মেয়ে বিয়ে দিয়ে পরিবারের সন্মান রক্ষা করছে। তারা বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে অবহিত থাকলেও মেয়েদের বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

খেপুপাড়া মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো.শাহাদাৎ হোসেন বিশ^াস সাংবাদিকদের বলেন, বখাটেপনার শিকার অভিভাবকরাই মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিচ্ছে । ছাত্রীদের স্কুলে আসা-যাওয়ায় সন্ত্রাসীর উত্যক্তের কারনে দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছে। তাই বাল্যবিয়ে রোধের মতো বখাটেপনা রোধেও কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

কলাপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কাজী রহুল আমিন জানান, বাল্যবিয়ের চাইতে দারিদ্রতা বেশি সমস্যা এখানে। তারা বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে স্কুলে সচেতনতামূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছেন। তবে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে সবার আগে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম সাদিকুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, বাল্যবিয়ে রোধে সরকারি নির্দেশনা কঠোরভাবে কার্যকর করা হচ্ছে। বাল্যবিয়ে রোধে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে একাধিক অভিযুক্তকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং বিয়ের রেজিস্ট্রারদের নিয়ে এ বিষয় আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে।

(এমকেআর/এএস/নভেম্বর ২৮, ২০১৬)