শেখর রায়


স্বাস্থ্য যখন পন্য, লোক ঠকিয়ে, রুগীর মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবার উপাদান, সামাজিক দায় দায়িত্বহীন চিকিৎসকের আলিসান জীবন ধারা বজায় রাখার ধান্দাবাজি, মুনাফাখোরের স্বাস্থ্য ব্যবসা ফুলে ফেঁপে লালে লাল হয়ে যাবার এক অনিয়ন্ত্রিত কারসাজি, সরকারি দপ্তরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস্তু ঘুঘুদের দপদপানি, অসৎ ক্ষমতাসীন রাজনীতির দাদাগিরি, মারমুখি লেলিয়ে দেয়া পুলিশ, অন্ধ বিচার ব্যবস্থা, সেই বিপরীত স্রোতের মুখে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে লড়ে কিছু বাপের ব্যাটা দেখিয়ে দিল যে দেখো আমরাও পারি। আর সেই গণ স্বাস্থ্য উদ্যোগের নাম শ্রমজীবী হাসপাতাল।

১৯৯৪ সাল কলকাতা। জ্যোতিবাবু পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। একটি খবরের কাগজের অফিসে বসে সম্পাদকের হুকুম তামিল করে সম্পাদকি বয়ান লিখছি। ফোন এল যে সিপিএমের ক্যাডার বাহিনী ও পুলিশের মিলিত আক্রমণে বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতাল লণ্ডভণ্ড। মানুষের দানে গড়ে তোলা এই গণ স্বাস্থ্য উদ্যোগ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সব ফেলে, দিলাম দৌড়বেলুড় শ্রী রামকৃষ্ণ মিশনের পাশে শ্রমজীবীতে। দেখলাম, চার পাঁচটা রোগীর খাট বেঞ্চি, চেয়ার টেবিল, ওষুধ পত্র, গজ ব্যান্ডেজ তুলোসহ চিকিৎসার নানাবিধ সরঞ্জাম শের শাহর গড়া গ্রান্ট ট্রাঙ্ক রোডের উল্টেপাল্টে পড়ে আছে। চিকিৎসা রত রোগিরা বসে আছে রাস্তার ধারে। কেউ যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কি নির্মম সে দৃশ্য। লোকে লোকারণ্য। না কোন মিশনের হিন্দু সাধু মহারাজেরা কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এসেছে শুধু অগুন্তি সাধারণ মানুষ। জমি বিল্ডিঙ্গের মালিকের দালাল পুলিশ-সিপিএম সংগঠিত বর্বরতার প্রতিবাদে সবাই সোচ্চার।

ঠিক হল হবে প্রতিবাদে এক মহামিছিল। তাই হল। আমরা সকলে যোগ দিলাম। বেলুড় শ্রীরামপুর সমগ্র এলাকাতে প্রদক্ষিণ করল সেই মিছিল যা ক্রমে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছিল। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সিপিএম গুণ্ডাদের কটূক্তি গালিগালাজ উপেক্ষা করে মিছিল হাসপাতালের সামনে ফিরে এল। সকলে মিলে শপথ নিল হাসপাতাল জনস্বার্থে পুনর্গঠন করা হবে এবং আমরা কারখানা বাড়ি ছেড়ে চলে যাব না, আবার ঢুকব,আবার হাসপাতাল তৈরি করব। গন প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে গেল সিপিএম গুন্ডা বাহিনী, সরে গেল পুলিশ। শুরু হল শ্রমজীবী হাসপাতাল নতুন করে। পালাক্রমে পাহারা দিতে শুরু করে দিল কারখানার শ্রমিক, সাধারন মানুষ। গন প্রতিরোধের কাছে হার মেনে মালিকের দালাল বাহিনী করল পুলিশ কেস। উদ্দেশ্য কেসের পর কেস দিয়ে জেরবার করে দেয়া ফনি ভটচাজ ও তার সহকর্মীদের। হয়রান করেছে আমাদের, কিন্তু ওদের জিততে আমরা দেই নি দেব না।

দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হল আমার ইংরাজি প্রবন্ধ। শাসক সিপিএম সরকারের বিরুদ্ধে হইহই ও ছিছি পড়ে গেল। মানবাধিকার কমিশন,হাইকোর্টে আমাদের বন্ধু সাধন উকিল লড়ে গেল। আমি ও কিরীটী রায় তাকে যথা সম্ভব সাহায্য করে গেলাম। কমিশন রাজ্য সরকারের উপর ২৫০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ দিল, হাই কোর্ট সরকারকে তীব্র ভৎসনাকরল। জয় হল শ্রমজীবী হাসপাতালের।

শ্রমজীবী হাসপাতাল প্রধানতঃ ছিল একটি বন্ধ কারখানা ইন্দো জাপান স্টিল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস বাড়িতে। কারখানাটি মালিক আচমকা বন্ধ করে দেয়। কর্মহীন হয়ে পড়ে প্রায় ৮০০ শ্রমিক। কিন্তু শ্রমিকরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা কেউ কারখানা ছেড়ে কেউ চলে যাবে না, গেলেই মেশিন পত্র সব সরিয়ে নেবে মালিক, খালি জমি ও বিল্ডিং বিক্রি করে দেবে। এইবার সিপিএম দলের দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠে, জমি বাড়ি বেচা কেনার সব দায়িত্ব ওদের। সেখানে কেন থাকবে শ্রমিক পরিবারের কল্যানের জন্য এমন স্বাস্থ্য উদ্যোগ। এতো তাদের বাড়া ভাতে ছাই স্বরুপ। কারখানা যখন চালু ছিল, কমরেডরা তোলাবাজি কোরতে শ্রমিকদের কাছে আসতো। যেই কারখানা বন্ধ, আর কেউ তাদের ধার মাড়াতে আসতো না। বন্ধ কারখানার শ্রমিকেরা ESI চিকিৎসার কোন সুবিধা পেত না। রাজ্য সরকারেরও ছিল না কোন আইনি দায়বদ্ধতা। ফলে ওরা মরুক বাচুক কার কি এসে গেল। কিন্তু যেই ওরা নিজেরা নিজেদের মত করে একটু বেঁচে থাকার চেষ্টা কোরতে শুরু করল, আর ঠিক তখনি ঝাপিয়ে পড়ে আক্রমন কোরতে শুরু করে দিল। এরা ছিল কম্যুনিস্ট, বামপন্থী। ধিক্কার !
মেহনতি শ্রমজীবী মানুষ তার নিজের বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নেবার চেষ্টা করে। ১৯৮০ দশকে ইন্দো জাপান স্টিল কারখানার কর্মরত শ্রমিকেরা সেই চেষ্টা থেকে পিছিয়ে আসেনি।

খামারপাড়া শ্রমিক বস্তি ছিল দুর্গন্ধ, রোগ শোক নিয়ে বেঁচে থাকা এক অঞ্চল। কারখানার বামপন্থী CITU ইউনিয়ন ঠিক করে আগে নিজেদের বস্তি উন্নয়ন নিজেরাই করার চেষ্টা করে দেখি। ওরা জাগিয়ে তুলল বস্তিবাসীদের যে এসো আমরা পথ ঘাট পরিস্কার করি, নর্দমা সাফ করি, ঘরের আশপাস সাফ করি। নিজেরাই গড়ে তুলি স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রচার অভিযান। এই অভিযানের পাশে এসে দাঁড়ালো একদল সমাজ সচেতন ছেলেমেয়ে, যারা কলকাতার বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য পাশ করে বেরিয়েছে। ছাত্রাবস্তায় যে সব ছেলেমেয়েরা গড়ে তুলেছিল জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন। দাবী ছিল, চিকিৎসা মানুষের অর্জিত অধিকার, ফিরিয়ে দিতে হবে তাকে। চিকিৎসা নিয়ে মুনাফাখোরি, দুর্নীতি ও অসাধু কাজ কারবার বন্ধ কোরতে হবে। সিপিএম জামানায় জনস্বার্থে ডাক্তারদের এই দীর্ঘ আন্দোলন ভেঙ্গে দিতে সব রকম হীনচেষ্টা করেছিল জ্যোতি বাবুর সরকার। ভেঙ্গে দিলেও কিন্তু সেই আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল এক ঝাঁক নক্ষত্রকে। আর তার মধ্য থেকে উঠে এসে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল অনিল সাহা,পল্লব দাশ, পরের দিকে নবারুন ঘোষাল ইত্যাদি অনেক অনেক ডাক্তার। কেউ এসেছে ইউরোপ আমেরিকার লোভনীয় রোজগার ছেড়ে। কেউ দেশের সরকারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছে। যাদের নিঃস্বার্থ অবদান মানুষ কোনদিন ভুলে যাবে না। ঢাকাইয়া বাঙ্গাল ম্যানেজমেন্ট গুরু মলয় ও তার সুপুত্র অরিন্দম চৌধুরী দুহাতে সাহায্য করে গেছে নিঃস্বার্থ ভাবে। এমন কত মানুষ যে আছে পর্দার আড়ালে যার কোন শেষ নেই। বহু মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমের অবদানে আজকের এই শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প সমিতি।

সুদীর্ঘ ২৫ বছরের এই স্বার্থত্যাগ সৃষ্টি করেছে চারটি শ্রমজীবী হাসপাতাল এই পশ্চিম বঙ্গে। ১) বেলুড় ২) কোন্নগর ৩) সরবেরিয়া সুন্দরবন ৪) কোপাই শান্তিনিকেতন। সরকার মুখ ফিরিয়েও কোন দিন এদের দেখেনি। এরা কোন NGO নয়। শুধু নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের দানে। হাসপাতাল চলে একটি কার্যকরী সমিতি দ্বারা যেখানে আছে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, শ্রমিক প্রতিনিধি, এলাকাবাসী। কোন রাজনৈতিক দলের লোক থাকতে দেয়া হয় না। কেউ জমি বাড়ি দান করে দিয়েছে, কেউ দিয়েছে টাকা সাধ্যমত যার পাই পাই হিসেব দেয়া হয় সাধারন মানুষের সাধারন সভায়। লাভ কামাইয়ের উদ্দেশ্যে এই স্বাস্থ্য উদ্যোগ গঠিত হয়নি বলে কিন্তু নিখরচায় চিকিৎসা হয় না, যেটুকু ন্যায্য খচর সেটুকুই নেয়া হয় রুগীর কাছ থেকে। ওরা দেখিয়ে দিয়েছে মাত্র ৪৫০০ টাকা নিয়ে গল ব্লাডার, লেপারস্কপি অপারেশন করা যায় যেখানে প্রাইভেট স্বাস্থ্য পরিসেবা ৩০০০০ থেকে ৪০০০০ হাজার পর্যন্ত বিল করে দেয়। ওরা মাত্র ২৫০০০ হাজারের বিনিময়ে হার্ট অপারেশন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। যেখানে পার্টির কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা পকেট কেটে নিয়ে নিচ্ছে ওই সব স্বাস্থ্য ব্যাবসায়িদের দলবল। এই হাসপাতালের ওষুধ বাজার মুল্য থেকে অস্বাভাবিক কম দামে পাওয়া যায়। যদিও তার উন্নত গুনমান নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে না। এইভাবে গন মানুষের সাহায্য সহায়তা নিয়ে এগিয়ে চলেছে শ্রমজীবী হাসপাতাল। উপকৃত হচ্ছে লাখে লাখে দরিদ্র সাধারন রুগী মানুষ। https://www.sramajibihospital.org/

লেখক : পশ্চিম বাংলার গণমাধ্যম কর্মী ও গবেষক।