প্রবীর সিকদার


আমার জীবন যৌবনের একটি দীর্ঘ সময় নিজের এলাকায় শিক্ষা আন্দোলন করেছি; দারুণ দাপটের সাথে করেছি শিক্ষকতা। বছরের পর বছর সাধারণ মানুষের কাছে হাত পেতে পেতে প্রতিষ্ঠা করেছি বেগম রোকেয়ার নামে বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও একাধিক শিশু বিদ্যালয়। আমার প্রতিষ্ঠা করা বিদ্যালয়ে আমিই ছিলাম প্রধান শিক্ষক। অজ পাড়াগাঁয়ে  শিশু অধিকার নিয়ে কাজও কমদিন করিনি। যে সময়ে জাঁকজমকের সাথে আমার প্রতিষ্ঠা করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাণময় পরিবেশে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হতো তা তখন অনেকে স্বপ্নেও ভেবে দেখেননি, আসলেই দেশে একদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন জাতীয় শিশু দিবস হিসেবেই পালিত হবে! ওই সময়ে আমি দেখিনি আমার এলাকা ও এলাকা সংশ্লিষ্ট চারদিকের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন করতে। কিন্তু আমার প্রতিষ্ঠা করা বিদ্যালয়গুলোতে ১৫ আগস্ট পালিত হয়েছে গাম্ভীর্যের সাথে; বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নিয়ে ছাত্রী ও ছাত্ররা নগ্ন পায়ে শোক শোভাযাত্রা করেছে; অনেক শিক্ষার্থীর চোখে ঝরেছে জলও। প্রথম দিন থেকেই জাতির জনক হিসেবেই আমার ওই বিদ্যালয়গুলোতে শোভা পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। শুধু বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর সম্মান জানানোর কারণেই বৈরি রাজনৈতিক সময়ে ওই বিদ্যালয়গুলোকে মাশুলও দিতে হয়েছে অনেক। বছরের পর বছর  সরকারি সহায়তা ও এমপিও ভুক্তি বঞ্চনা ছিল বড় নির্মম। বিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি বলেছি, ওই ছবি নামানোর আগে আমার লাশ ফেলতে হবে। ওই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে আমার সাথে আমার সহকর্মী শিক্ষকেরা গভীর মমতায় পেটে পাথর বেঁধে ওই  বিদ্যালয় গড়েছেন।

ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয় থেকে ছাত্রলীগ মনোনীত প্যানেল থেকেই আমি সরকারি একটি কলেজ সংসদে বিপুল ভোটে একটি সম্পাদকের পদ পেয়েছিলাম। পরে পারিবারিক অনিবার্য প্রয়োজনেই কর্মজীবন তথা শিক্ষকতায় ঢুকে পড়ায় আর আমার আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠা হয়নি। শিক্ষকতা, শিক্ষা আন্দোলন ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করতে আমার প্রেরণা ও আদর্শ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমার শক্তি সাহস ও ভরসার কেন্দ্রেও ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমার পোশাকেও ছিল তার ছাপ। বহুদিন আমি সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি, মুজিব কোট ও কালো রঙের স্যান্ডেল পরেছি। তখন অনেকেই আমার পোশাক নিয়ে কটাক্ষ করতেন। অন্তত একজন জ্ঞানীগুণী মানুষ আমাকে মুজিব কোট না পরবার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ওই কোট বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের পোশাক; শিক্ষক হিসেবে তোমার সেটা পরা উচিত নয়। আমি সেদিন বলেছিলাম, আমি বিশেষ ওই রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী নই। বঙ্গবন্ধু মুজিব আমার মডেল, আমার পিতা। একাত্তরে বাবা হারানোর পর থেকেই আমি বঙ্গবন্ধুকেই পিতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করি। সেই পিতার আদর্শ বহন করতেই আমি মুজিব কোট পরি। তিনি সেদিন আমার উত্তরে খুশি হতে না পেরে বড্ড হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।

তারপর সময় গড়িয়েছে অনেক। দেশে বাড়তে থাকে মুজিব কোট পরা লোকের সংখ্যা। ওই জ্ঞানীগুণী মানুষটিও সুযোগ পেলেই মুজিব কোট গায়ে জড়িয়ে হাজির হন নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। এখন আর আমি মুজিব কোট পরি না। বঙ্গবন্ধু আদর্শের পোশাক আলমারিতে খুলে রেখে মনের গভীরে পরে নিয়েছি অনন্তকালের এক মুজিব কোট। এখন আমি ছাড়া আমার সেই মুজিব কোট আর কেউ দেখতে পায় না, হয়তো আর কোনোদিন দেখতেও পাবে না।