রাজীবুল হাসান, গাজীপুর : উত্তাল একাত্তর। একের পর এক ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হচ্ছে। জ্যান্ত মানুষের ওপর দানবের মতো চিৎকার করে ট্যাঙ্ক হামাগুঁড়ি দিচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। নিরস্ত্র বাঙালি নারী-পুরুষ আর শিশুদের ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে হত্যা করছে পাকিস্তানিরা। শুধু

তাই নয়, মা-বোনের সম্ভ্রমহানির নির্লজ্জ উল্লাসে মেতেছে নরপশুরা। ভয়াবহতম এমন সব খবরে আর স্থির থাকতে পারলেন না এস এম নূরুল ইসলাম। গ্রামের মুক্তিপাগল অর্ধ শতাধিক যুবকের সঙ্গে পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে শপথ নিলেন দেশ স্বাধীন করেই তবে ঘড়ে ফিরবে। ঠিক তাই করলেন, চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার আগ পর্যন্ত অসীম সাহসিকতার সঙ্গে তিনটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিলেন অকুতোভয় এসএম নূরুল ইসলাম।

স্বাধীনতার এতকাল পর গত ১ ডিসেম্বর বর্ণনা করলেন যুদ্ধ জয়ের নানান স্মৃতি। নিজের দেখা বীভৎস নানা দৃশ্যের কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আসছিল তার। চোখের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হওয়া এক সহযোদ্ধার কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। এস এম নূরুল ইসলাম ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার শৈলাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এসএম জব্বার ছিলেন একজন কৃষক। আর মা বেগম মিলনজান গৃহিণী। দুই ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে নূরুল ইসলাম দ্বিতীয়। টগবগে এক যুবক ১৯৭১ সালে এসএসসি পরিক্ষার্থী। সেই অবস্থাই মুক্তিপাগল নূরুল ইসলাম প্রিয় দেশকে স্বাধীন করতে যাপিয়ে পরে মুক্তিযুদ্ধে।

৬ মার্চ সন্ধ্যায়। ঢাকার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন নূরুল ইসলাম। উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনা। ভোর সকালে ঢাকায় পৌছায়। কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে হেটে হেটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য ৭ মার্চ ভোর বেলা চলে গেলেন রেসকোর্স ময়দানে। খুব কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হলেন। ফিরে এলেন বাড়ি। নূরুল ইসলাম তখন গাজীপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। বাড়িতে এসে শৈলাট উচ্চ বিদ্যালয়ে কাজিমুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলেন। সাইদুর রহমান, শাহজাহান, জবান মাষ্টার, আ.আজিজ, নূরুল ইসলাম মাষ্টার, লতিফ, মোহাম্মদ আলী, ফটিক, মফিজ, সোহরাফ, জহিরসহ আরো অন্তত চল্লিশজন যুবক নিয়ে প্রতিদিন স্কুলের মাঠে চলে প্রশিক্ষণ আর নানান পরিকল্পনা। সবার উদ্দেশ্য দেশ স্বাধীন ।

এপ্রিলের শুরুর দিকে কোন এক সন্ধ্যায় মাকে স্কুলে মিটিং এর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন নূরুল ইসলাম। দুই হাতে দুমুঠো চিড়া, চাচাতো ভাই আ.রহিমের একটা হাফ শার্ট আর পকেটে থাকা পচিশ টাকা চুরি করে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরেন নূরুল ইসলাম।

প্রথমে সুবেদার কসিমউদ্দিনের নিকট প্রায় এক মাস এবং পরে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মেজর আফসার বাহিনীতে যোগদেন নূরুল ইসলাম। সাড়ে চার হাজার সদস্যের এ বিশাল বাহিনী ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ ও ঢাকা সদর উত্তর (বর্তমান গাজীপুর জেলার শ্রীপুর) ১৭ এপ্রিল এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। সামরিক বাহিনীর আদলে গঠন করেন আফসার বাহিনী। নূরুল ইসলাম তার লোকজন নিয়ে ভালুকা, গফরগাও, ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, কালিয়াকৈর ও শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকা শত্রু মুক্ত করেন।

২৮ অক্টোম্বর ১৯৭১। তখন সর্বত্রই যুদ্ধ আর যুদ্ধ। নির্দিষ্ট রণাঙ্গন বলতে কিছু নেই। মেজর আফসারের নেতৃত্বে নূরুল ইসলামসহ অন্তত ৫০ যুবক মল্লিক বাড়ীর চাঁনপুরে অবস্থান নিলেন। পাকিস্তানিরা ওই গ্রামে আক্রমণ করতে আসছে এমন খবরে তারা একত্র হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানিদের সাথে শুরু হয় তুমোল যুদ্ধ ।

এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর গুলিতে তিন পাক সেনাসহ ৫ রাজাকার নিহত হয়। পাড়াগাঁও ও চাঁনপুরের যুদ্ধে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহম্মেদ ও মুন্নেছ আলী। নূরুল ইসলামদের বীরত্বে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থা বেগতিক বুঝে পিছু হটতে শুরু করে। এর আগে তারা সহযোদ্ধাদের লাশ উদ্ধারের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। চাঁনপুরের যুদ্ধের পর নিশ্চিত মৃত্যু জেনে ঘাতকবাহিনী আস্তে আস্তে পালাতে থাকে। হানাদার গাটিতে ৮ ঘণ্টা যোদ্ধ করে মল্লিকবাড়ী হানাদার মুক্ত করেন নূরুল ইসলাম।

শ্রীপুরের মাওনা লবণদাহ পাথার পারের চূড়ান্ত যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, খবর আসে শ্রীপুরের শৈলাট হয়ে মাওনা দিয়ে জয়দেবপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে অসংখ্য পাকসেনা। আমরা প্রায় ৩০ জনের এক মুক্তিযোদ্ধা দল অস্ত্র নিয়ে মাওনা বাজার পাথারের পূর্ব পাশে অবস্থান নেই। সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী যখন পাথার ব্রিজের পশ্চিম পাশে ঠিক তখনই কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা গুলি ভর্ষণ শুরু করি। বিপরীত দিক থেকে পাক সেনারাও আমাদের ওপর বেপরোয়া পাল্টা আক্রমণ করতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাদের ছুরা বুলেট হঠাৎ আমার ডান পায়ে লাগে। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পরি। সহযুদ্ধাদের সহযোগীতায় স্থানীয় ডাক্তারা প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। এই যুদ্ধে মেজর আফসারও আহত হন। টানা চার ঘন্টার এই সম্মুখ যুদ্ধে আট পাকবাহিনী মারা যায়।

নূরুল ইসলাম বলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর আমাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে মেজর আফসার আমাকে এসে নিয়ে যান ময়মনসিংহের রুকেয়া গার্লস কলেজে। সেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলামের হাতে আমিসহ প্রায় ৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা দিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে যায় আর আমি আসি পুনরায় হাসপাতালে। হাসপাতালে র্দীঘদিন চিকিৎসাদিন অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ স্ট্রাস কর্তৃক লেখা পড়া করি। একাত্তরের নানান স্মৃতি, প্রিয় সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর বীভৎস দৃশ্য আর পাকিস্তানি সেনাদের মর্টার শেলের আঘাতের ক্ষত শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন এই যোদ্ধা। অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন সমাজ গঠনের ব্রত নিয়ে দেশ স্বাধীন করলেও তার স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি বলে মনে করেন একাত্তরের এই বীরযোদ্ধা।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সব কিছু উল্টে গেছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন। কিন্তু আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যা চেয়েছিলাম সেটা তিনিও এখনও পারেননি। আমার চেয়েছিলাম ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু এখনও তো ধর্মেও নামে দল আছে। আমরা যে যুদ্ধ করেছি,সেটা তো এজন্য করিনি।

(আরএইচ/এএস/ডিসেম্বর ০৭, ২০১৬)