দীপক চক্রবর্তী, মাগুরা : আজ ঐতিহাসিক ৭ ডিসেম্বর মাগুরা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মাগুরা পাক হানাদার মুক্ত হয়। এ সময় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তৎকালিন মাগুরা মহকুমায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রড়ে তোলার ক্ষেত্রে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

এ সময় মাগুরা আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বাধীন শ্রীপুর বাহিনী, মহম্মদপুরের ইয়াকুব বাহিনী, মহম্মদপুর ফরিদপুর অঞ্চলের মাশরুরুল হক সিদ্দিকী (কমল বাহিনী), মাগুরা শহরের খন্দকার মাজেদ বাহিনী এবং মুজিব বাহিনী বিশেষ সাহসী ভূমিকা নিয়ে পাক সেনা ও স্থানীয় রাজাকার আল বদর বাহিনীর সাথে প্রানপণ যুদ্ধ করে। এ সময় কমল বাহিনীর প্রধান মাশরুরুল হক সিদ্দিকী কোমল ভাটিয়াপাড়ায় এক সম্মুখ যুদ্ধে গুলিতে তার একটি চোখ হারান। শ্রীপুর বাহিনীর রণাঙ্গনে একের পর এক বীরোচিত অভিযান পাক হানাদার বাহিনীকে তটস্থ করে তোলে। শ্রীপুরের শ্রীকোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ বাহিনী মূলত মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর এলাকাজুড়ে পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আলবদরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।

মাগুরা মুক্ত দিবসের পূর্বদিন ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হবার সংবাদ পেয়ে ফরিদপুর জেলার নয় ব্যক্তি ভারত থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে যাবার সময় ৭ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে শালিখা উপজেলার জুনারী গ্রামে রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। রাজাকাররা তাদের ধরে এনে হাজরাহাটি গ্রামের অধির অধিকারীর বাড়ির দক্ষিনে চিত্রা নদীর পাড়ে বর্বরচিত নির্যাতন শেষে তাদের গুলি করে হত্যা করে। হত্যার আগে এদের মধ্য থেকে একজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা ৮ ব্যক্তির লাশ নদীর পাড়ে গর্ত খুঁড়ে গনকবর দেয়। এখানে যারা শায়িত আছেন তারা হলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার জয়পাশা গ্রামের যদুনাথ গুহ, পঞ্চানন পাল, হরিপদ দাস, নিত্যানন্দ ভদ্র ও পরমেশ্বরদী গ্রামের মনোরঞ্জন দত্ত। নগর কান্দা থানার সাধুহাটি গ্রামের নাড়– গোপাল রায়, ফুলবাড়িয়া গ্রামের সুশেনকর ও অজ্ঞাত এক ব্যক্তি।

অধির অধিকারীর স্ত্রী সবিতা রানী বলেন, আমার তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে। আমরা গ্রামের কয়েকজন গৃহবধু নদীতে স্নান করতে এসে দেখি রাজাকাররা ৮ ব্যক্তিকে ধরে এনে নদীর ঘাটে নির্মমভাবে নির্যাতন করছে। তারা জল খেতে চাইলে রাজাকারা ডাবের খোলায় প্রসাব করে তা খেতে দেয়। তারপর তারা গুলি করে সবাইকে হত্যাকরে। এই গনকবরটি সংরক্ষনের কোন উদ্যোগ না নেয়ায় ঝোপ জঙ্গলে পূর্ণ হয়ে গেছে এবং নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সরদার ফারুক আহমদ বলেন সরকার বদ্ধভ’মি চিহ্নিত করণ ও গনকবর সংরক্ষন করার ঘোষনা দিলেও দীর্ঘ দিনেও চিহ্নিত করন ও সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্নগুলি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজন।

এ গেরিলা বাহিনীর ব্যাপক আক্রমনের মুখে পাক বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। এ দু বাহিনী ৬ ডিসেম্বর মাগুরাকে হানাদার মুক্ত করতে নিজনান্দুয়ালী গ্রামে ও বিভিন্ন পাকিস্থানী ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। একই সাথে মিত্রবাহিনীর আগ্রাসনের ভয়ে পাকিস্তানী সেনারা রাতারাতি মাগুরা শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পরদিন ৭ডিসেম্বর মাগুরা শত্রুমুক্ত হয়। হানাদার মুক্ত হওয়ার আনন্দে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নামে সারা শহরে। জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা মাগুরা এলাকা।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার মোল্যা নবুয়ত আলী জানান, ৭ ডিসেম্বর মাগুরা মুক্ত দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালন উপলক্ষ্যে মাগুরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জেলার বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সকালে শহীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শহরের নোমানী ময়দানে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্থম্ভে পুস্পস্তবক অর্পণ, বর্ণাঢ্য র‌্যালী, সৈয়দ আতর আলী পাঠাগার চত্বরে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

(ডিসি/এএস/ডিসেম্বর ০৭, ২০১৬)