মাহবুব আরিফ


বাংলা একাডেমী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবী শব্দের সংজ্ঞা বা বুদ্ধিজীবী অর্থে যেটা বোঝায় সেটা হচ্ছে, লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতি-সেবী। যারা দেশের স্বাধীনতাকে সম্মান জানিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য তাদের বিচার, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে কাজ করে। তবে বিভিন্ন কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদের ব্যাখ্যা বিভিন্ন ভাবে দেয়া থাকলেও পুরো বিষয়টি দেখলে বোঝা যায় যে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট কালেই বুদ্ধিজীবীরা তাদের মেধা ও কর্ম দিয়ে সুশাসন, সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যে এগিয়ে আসেন। একটি জাতির মেরুদন্ডই হচ্ছে এই বুদ্ধিজীবী সমাজ।

আমাদের পাক ভারত উপ মহাদেশের ঔপনিবেশিক শাসন আমল থেকেই এই বুদ্ধিজীবী সমাজ স্বাধিকার আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। রাজা রামমোহন থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত এই বুদ্ধিজীবি ব্যক্তিত্বরা না থাকেলে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সেই স্বপ্নের তিমিরেই নিমজ্জিত থাকতো।

সমাজের গরীব ও অশিক্ষিত নিষ্পেষিত মানুষরাও এই বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে যখন সাধারণ জনগোষ্ঠী, সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাদী সমাজ দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে ঠিক তখনি বুদ্ধিজীবী সমাজ নিষ্পেষিত ও অত্যাচারিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলে সত্যিকার অর্থে ব্রিটিশরা যা ঘটাতে সাহস পায়নি ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আল বদর নামে প্যারা মিলিটারি ফোর্সের সাহায্যে বাংলাদেশকে মেধা শূন্য করে পঙ্গু করে দিতে বুদ্ধিজীবী সমাজ নিধনে তৎপর হয়ে ওঠে, এই সহজ বিষয়টি যদি অনুধাবন করতে না পারি তবে বাঙালী হয়ে জন্মগ্রহণ করাটাই বৃথা। বুদ্ধিজীবী সমাজের চিন্তা ধারা জাত, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে , মনুষ্য জাতির কল্যাণে সমাজে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সর্বদাই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক বুঝতে পেরেছিল যে পূর্ব পাকিস্তান একদিন বাংলাদেশ হয়ে যাবে তাই রাও ফরমান আলী এই দেশকে পঙ্গু করে দিতে যে নীল ছক একে ছিল তার একটি অংশ হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর।

একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিশাল শ্রেণীর লম্পট, ধান্দাবাজদের আগমন ঘটেছে তার অনেক কারণের একটি আংশিক মূল কারণ এই বুদ্ধিজীবী সমাজে দীর্ঘ ৪৭ বছরের মেধা শূন্যতা। আমরা একটি বৃহৎ বুদ্ধিজীবী সমাজ সেই ১৯৭১ সালেই হারিয়ে ফেলি, কাজেই রাজনীতির মাঠেও এই শূন্যতাকে পূরণ করতে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের আগমন ঘটে | এ ক্ষেত্রে পুরো বিষয়টি শুধুই আমাদের দুর্ভাগ্য বৈ অন্য কিছু নয়।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে বর্তমান সময়ে রাজনীতির অশুভ থাবা থেকে মুক্তি দিতে বর্তমান বুদ্ধিজীবী সমাজ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে অনেকটাই শক্তিহীন বা বুদ্ধিজীবী সমাজ নিষ্ক্রিয়।

সবার অগোচরে সাম্প্রদিকতার ধোয়া তুলে বাংলাদেশে সেই অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দেবার চেষ্টা করছে, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, প্রকাশক, সাংবাদিক, চিন্তাবিদ, শিক্ষিক, পুরোহিত, সমাজ সেবক মানে এই বুদ্ধিজীবি সমাজ গোষ্ঠিকে অত্যচার, সম্মানহানি, মামলা বা চাপাতির আঘাতে নিধন করার সংকল্প নিয়ে মাঠে নামা এই একি শক্তিকে আমাদের সমূলে উত্পাটন করতে হবে।

লেখক : সুইডেন প্রবাসী।