নূর-ই-সাবা আশা


নারী কি শুধু শারীরিক ভাবেই নির্যাতিত হয়? না। সভ্য সমাজে অসভ্যতা ভদ্রতার আড়ালে নোংরামি। পরিবার থেকে সমাজ-রাষ্ট্রের প্রায় সব জায়গাতে নারীর যেমন অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তেমনি আবার অধিকার হরণ, নির্যাতন-অত্যাচারও দিন-দিন বেড়েই চলেছে।

নারীর ক্ষমতায়ন কী বাসের সামনের মহিলা সিটে সীমাবদ্ধ? গ্রাম থেকে শহর, শেকড় থেকে শিখর, বাস্তবতা থেকে সামাজিক যোগাযোগ আর গণমাধ্যম সবকিছুতেই নারীরা আজ নির্যাতিত। তবে ভিন্নতা শুধু নির্যাতনের ধরণে, নির্যাতনের দৃশ্যে।

প্রায়ই লক্ষ করা যায়, ফসবুক নামক জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শত-শত ফেসবুক একাউন্ট আছে, ফ্যান পেইজ আছে যেখানে মেয়েদের অপমান-অপদস্ত করে কিছু লিখলেই হাজার-হাজার লাইক চলে আসে। পাশাপাশি শেয়ার আর অশ্লীল কমেন্ট-এর অভাব নেই। যেন মেয়েদের নিয়ে ট্রল করতে পারলে খুব সহজে সেলিব্রেটি হওয়া যায়।

অথবা কোনও মেয়ে ইচ্ছাবশত বা তাঁর অজান্তে কোনও বন্ধুর ক্যামেরায় একখানা ছবি তুলেছে যাতে তার ওড়না ঠিক মত নেই কিংবা অপরের চোখে তার মতন করে অশ্লীল দেখায়। ব্যাস! সেই ছবি নিয়ে শুরু হয় ফেসবুক অশ্লীলতা, সমালোচনা, নোংরামি। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় করার জন্য করা হয় ব্যক্তিগত আক্রমন।

একটা ফেইক আইডি থেকে কোনও মেয়ের ফোন নাম্বার নিয়ে যদি কেউ ‘ফোন সেক্সের জন্য কল করুন’ এই শব্দটি লিখে দিলে শুরু হয় দৌড় প্রতিযোগিতা। কে কার আগে ফোন করবে কিংবা কে এই ফোন সেক্সে নিজেকে বিলিয়ে দিবে সে দৌড়ে...। কিন্তু একবারও চিন্তা করে না, এই মোবাইল নম্বরটি তাঁর বোন বা মা’রও হতে পারে।

এই ধরনের অশ্লীর বিরক্ত, নির্যাতন, মানসিক অত্যাচারের জন্য আমরাই দায়ি। আমরা যারা সুশীল সমাজে বসবাস করছি বা নিজেদের সভ্য সমাজের আধুনিক নাগরিক মনে করছি, তাঁরাই কখনও নিরবতায় আবার কখনও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকি। অন্যদিকে ভাইরাল করা এই পেইজগুলোতে লাইকের শীর্ষে আমরাই রেখেছি। আর এই ধরনের অশ্লীলতা থেকে খেলোয়াড় তাঁর ছোট বোনকে নিয়ে ছবি তুললেও রক্ষা পায়না নষ্টদের হাত থেকে।

এবার আসি একটু রাজনীতিতে...। এখানেও নারীদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। নারী নেত্রীর নেতৃত্ব অনেক সময় নির্ভর করে নেতাদের নোংরা লোভ-লালসার দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই নেতাকে খুশি করো, ঐ নেতাকে খুশি করো, খুশি করো সিনিয়রদের। শুধু পদপদবীই নয়, নারীরা তাঁদের খুশি করতে পারলে যেন আকাশের চাঁদটুকুও পাওয়া সম্ভব।

একটা মেয়ে যদি রাজনীতিতে উন্নতি করে কোনও ধরনের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া আমরা সেই মেয়ের সামনে নম-নম করলেও পিছনে-পিছনে বাঁকা কথা বলি, সমালোচনা করি। আর এখানে পুরুষের সাথে সংযুক্ত হয়ে নারীদেরই কিছু অংশ খুব সহজেই ঐ নারীর বিরুদ্ধে অশ্লীল মন্তব্য ছড়াতে কুষ্ঠাবোধ করি না। বড় কোন নেতার শয্যাসঙ্গিনী বা তাঁর মন খুশীর পরিপ্রেক্ষিতে নেতৃত্বের জায়গায় আসিয়ান বলে ভেবে বসি। বন্ধুদের এ-কান থেকে সে-কানে গুনগুন করতে থাকি।

আমাদের দেশে কোনও মেয়ের যদি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, সাংগঠনিক দক্ষতা, দেশপ্রেমে কাজ করার ইচ্ছায় এগিয়ে থাকে, তবুও তার রাজনৈতিক পোষ্ট সবার পিচনে পরে থাকে। কারণ, সে লাঠি হাতে নিয়ে মারামারি করতে পারবেনা। তাঁকে দুর্বল ভেবে সরিয়ে রাখা হয়। অবহেলা বঞ্চনা সহ্য করতে হয়। কারণ তার কোনও লিংক বা লাইন নেই, নেই বড় কোনও নেতার সাথে যোগাযোগ। অনেক সময় ঐ নারী নেত্রী অবহেলিত হয় এলাকায় বা ক্যাম্পাসে। গ্রহণযোগ্যতা বা যথেষ্ট কার্যক্ষমতা থাকা সত্ত্বের নারীদের দমিয়ে রাখার কৌশল গ্রহণ করে।

গ্রামের অধিকাংশ মহিলারা বিদেশী চ্যানেল দেখে প্রতিবাদের ভাষা ভুলে পরকিয়া আর সংসারের চাবির গোছা হাতানোর পদ্ধতি শিখছে। আর আমরা শহুরে মেয়েরা হট ছবি তুলে আপলোড করছি অথবা লাইক দিচ্ছি মেয়েদের নিয়ে দেয়া হাস্যকর পোষ্টে। আবার আমরাই মিটমিটিয়ে হাঁসি তামাশা করছি।

এ-সবই আমার চারপাশ দেখা অভিজ্ঞতা। এগুলো সব নাম না জানা অঘোষিত নির্যাতন, অত্যাচার, অবহেলা, বঞ্চনা। যা প্রতিনিয়ত আমাকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাচ্ছে। নিরব-নিথর করে দিচ্ছে। প্রতিবাদের ভাষাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য কখনও এই তকমা, কখনও ঐ তকমা। আবার সাথে সংযুক্ত ধর্মীয় রীতিনীতি। আছে পারিবারিক বিধিনিষেধ। নারী যে সত্যিই অসহায় এক প্রাণী।

তৃতীয় বিশ্বের আধুনিক সমাজ-সভ্যতার এই যুগে নারীর বিরুদ্ধে যতই ষড়যন্ত্র করা হোক, যতই নারীকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্ঠা করা হোক; নারীরা এগিয়ে যাবেই। কারণ আমাদের সামনে নারীর নেতৃত্বের প্রতীক, নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক, নারীর গর্জে ওঠার প্রতীক, নারীদের এগিয়ে চলার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর কন্যার শেখ হাসিনা।

সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর। এই সময় ঘরে বসে নিরব-নিথর হয়ে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করার জন্যে নয়। প্রতিবাদ করুন সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে, সবজায়গায়। তা রাজনৈতিক মাঠ থেকে ফেসবুকে কিংবা ফেসবুক পেইজের প্রতিটি লাইনে...।

যে নারী সন্তান জন্ম দেবার ব্যথা সহ্য করতে পারে সে নারী কখনোই অসহায় নয়। সে সাহসী, খুব সাহসী। নিজেকে অসহায় ভাবা নারীদেরই বন্ধ করতে হবে। আপনি নারী, আপনিই পারবেন সকল লালসার জাল ভেদ করে সমাজকে বদলে দিতে।

অত্যন্ত দুঃখ লাগে, কষ্ট অনুভব হয়- নারীর উন্নয়নের পথে বাঁধা কিছু মেয়ে নিজেদের অসহায়ত্বকে শান্ত শিষ্টতা বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। দুর্বল নয়, সাবলম্বী হোন। অন্যের গলায় ঝুলে পড়ার চিন্ত বাদ দিয়ে নিজের মাথাটা কিভাবে সসম্মানে উঁচু রাখা যায় সেই চেষ্টা নারীদেই করতে হবে। উন্নতির পথে মেয়ে মানুষ শব্দটির বাঁধা উধাও হোক পৃথিবী থেকে। সবাই মানুষ পরিচয়ে এগিয়ে যাক।

লেখক : সহ-সভাপিত, বাংলােদশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ), রংপুর জেলা
সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, রংপুর মেডিকেল কলেজ শাখা।