আল ফয়সাল বিকাশ, বান্দরবান : আমি পড়তে চাই- আমাকে পড়ার সুযোগ দিন কথা গুলো দৃঢ়চিত্তে বলছিলেন বান্দরবানের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং বীর বিক্রমের ছোট নাতনি থুই মে চিং মারমা। বলছিলেন, আমার বাবাও নাই মাও নাই ঘরে টাকাও নাই আমি পড়তে চাই-আমাকে পড়ার সুযোগ দিন। শিউরে উঠার মতো এক অসহায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রজন্মের মুখে আকুতি শুনে। শিশুটির বয়স ৯ ছুঁই-ছুঁই। দারিদ্রতা কাকে বলে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু সংসারের অভাব কিছুটা আঁচ করতে পেরেই বুঝে নিয়েছে তার লেখা-পড়া হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।

অনাথ শিশু হিসেবে চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘে ভর্তি হওয়ার জন্য একটি ফরম সংগ্রহ করেছেন তার বড়বোন উমেচিং মারমা। কিন্তু ভর্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মেধা তালিকায় নাম আসবে কিনা তা অনিশ্চিত। মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়ী সম্প্রদায়ের গৌরব গাঁথা ইতিহাসের নাম বান্দরবানের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং বীর বিক্রম। ২ বছর হলো তিনি আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছেন। তবে তার কবরের কোন স্মৃতি চিহ্ন না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এদিকে বীর বিক্রমের কিছু স্মৃতি সম্বল করে তার পরিবারের সদস্যরা আর্থিক দৈনতাসহ নানা সমস্যায় দিন কাটাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা পোষ্যদের নিয়ে সরকারের নানা সুযোগ সুবিধার কথা বললেও পাহাড়ী এই মুক্তিযোদ্ধার পরিবারটি সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৬ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল বাশার নেতৃত্বে বাঙ্গালী সহযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন এবং বীরত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখার জন্য বীর বিক্রম উপাধি পান বান্দরবানের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং মারমা। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি রংপুর, লালমনিরহাট, বাঘবান্ধা, হাতিবান্ধা, ভুরুঙ্গামারি, কুড়িগ্রাম জেলার রায়গঞ্জের চৌধুরীহাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় যুদ্ধ করেন। বেশ কয়েকবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)’এ হাবিলদার মেজর হিসেবে কর্মরত অবস্থায় অবসর গ্রহন করেন। তিনি শহরের নিকটবর্তী লাঙ্গি পাড়ায় সরকারী অর্থায়নে নির্মিত এক তলা বিশিষ্ট ছোট্ট একটি বাড়ীতে থাকতেন এই বীর পাহাড়ী মুক্তিযোদ্ধা। পাহাড়ী মারমা সম্প্রদায়ের বীর বিক্রম কেতাব প্রাপ্ত এই বীর সেনা ৮০ বছর বয়সে ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিকেলে মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি ২ ছেলে ও ১ মেয়ে এবং ১০ নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।

ইউ কে চিং জীবিত থাকা অবস্থায় বড় ছেলে বাবুল মারমা’র সংসারের ৪ কন্যাকে দেখভাল করতেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর পুরো সংসারটি ভেঙ্গে পড়ে। বর্তমানে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সংসারের অবস্থা অত্যন্ত করুন। গত ২ বছর আগে দাদা (ইউ কে চিং)’কে হারানোর পর গত ১ মাস আগে পিতা (বাবুল মারমা)’কে হারিয়ে দিশেহারা বীর মুক্তিযোদ্ধার এই ৪ নাতনি। সংসারের এই বেহাল অবস্থায় অধ্যয়নরত ৩ নাতনির পাড়া-লেখা বন্ধ হয়ে গেছে। বড় নাতনি সেলাই কাজ করে কোন মতে দিন পার করছেন।

ইউ কে চিং এর বড় নাতনি উ মে চিং মারমা জানান, তার মা অনেক আগে মারা গেছেন বাবাও গত নভেম্বরে মারা যান। এখন তাদের কেউ নেই। আর্থিক সমস্যার কারণে তারা ৪ বোনের মধ্যে ৩ বোনের পাড়া-লেখা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন।
ইউ কে চিং-এর ভাগনী ওয়াং সা বু মারমা জানান, বীর বিক্রম মারা যাওয়ার পর তার ৪ নাতনি (৪বোন) আছে, তাদের মধ্যে ১জন এসএসসি পাশ করেছে, সেও এখনো বেকার। সরকারীভাবে তার একটি চাকুরী হলে সংসার চালাতে পারতো। বীর বিক্রম পরিবারের যারা আয় রোজগার করতো তারা সবাই মারা গেছে এখন এই সংসারের দায় কে নেবে?

এদিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের কোটায় ইউ কে চিং বীর বিক্রমের ছোট ছেলে লু হ্লা মং মারমা (লাবলু) ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে চাকুরী পান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে। তিনি জানান, সরকারীভাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য হিসেবে সহযোগিতা পেয়েছেন তবে তাদের ছেলে-মেয়েদের মানুষ করার জন্য তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। লাবলু আরো বলেন, বর্তমান সময়ে তিনি যা বেতন পাচ্ছেন তা দিয়ে তার ৫ জনের সংসার চালাতে হিমসীম খেতে হয়। কিন্তু তার বড় ভাই মারা যাওয়ায় তার ৪ মেয়ের ভরণপোষন এখন তার উপর পড়েছে। তিনি, পিতা-মাতা হারা অসহায় এই ৪ মেয়ের অন্ধকার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। তার বড় ২ মেয়ের মধ্যে যে কোন মেয়েকে একটি সরকারি চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিতে সরকারর উর্ধ্বতন মহলের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

ইউ কে চিং বীর বিক্রমের নামে প্রধান সড়ক হতে তার বাড়ী যাওয়ার সড়কটির নামকরণ করা হয়েছিল ইউ কে চিং বীর বিক্রম সড়ক। বর্তমানে সড়কটির একটি অংশ নদীর ভাঙ্গনে ধ্বসে পড়েছে। এলাকার লোকজন সড়কটির সংস্কারসহ লাঙ্গী পাড়াটি ইউ কে চিং বীর বিক্রমের নামে নামকরণ করার দাবী জানান। স্থানীয় বাসিন্দা মে থুই প্রু মারমা বলেন, তাদের লাঙ্গি পাড়ার নামটি পরিবর্তন করে ইউ কে চিং বীর বিক্রম পাড়া হিসেবে স্বীকৃতি এবং ভেঙ্গে যাওয়া একমাত্র বীর বিত্রম সড়কটি সংস্কারের দাবি জানান।

এ ছাড়াও তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ী সম্প্রদায়ের একমাত্র বীর বিক্রম ইউ কে চিং মারমার মৃত্যুর ২ বছর পার হলেও তার কোন সমাধি কিংবা স্মৃতি স্তম্ভ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কাশেম জানান, যে কোন কিছুর মুল্যে হোক তিন পার্বত্য জেলার এই বীর বিক্রমের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য সমাধি না হলেও স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করার অনুরোধ জানান। মুক্তিযোদ্ধা রতন জানান, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সব সময় অবহেলিত। ইউ কে চিং বীর বিক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সময় হয়তো আর বেশী দিন নাই, নামটাও মুছে যাবে। তিনি তিন পার্বত্য জেলার একমাত্র পাহাড়ী মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং বীর বিক্রমের স্মৃতি জাতির কাছে তুলে ধরার জন্য স্মৃতি সমাধি তৈরী করার জোর দাবি জানান।

প্রয়াত বীর বিক্রমের প্রাপ্ত খেতাব, বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রদত্ত সম্মাননা ক্রেষ্ট আর ফ্রেমে বাঁধা ছবির স্মৃতি অবলম্বন করে বেঁচে থাকার শেষ আকুতি। কিছু চাওয়ার ভাষা জানা নেই তাদের, পাওয়ার কদর বুঝে না, নেই তাদের কোন উচ্চাকাঙ্খাকা। সম্মান নিয়ে সমাজে বেঁছে থাকার সামান্য সহানুভুতি পারে মা-বাবা হারানো মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের এই ৪ কন্যার ভবিষত গড়তে।

(এএফবি/এএস/ডিসেম্বর ১৯, ২০১৬)