মো.আলী আশরাফ খান

আজ যখন বিশ্বব্যাপি মানবাধিকারের নামে চলছে চরম গলাবাজি;মিটিং-মিছিল, ব্যানার-ফেস্টুনসহ নানা রকমশ্লোগনের মাধ্যদিয়েবিশ্বনেতারামানবাধিকার রক্ষার আওয়াজে কাঁপিয়ে তুলছেন শহর-বন্দর, রাস্তা-ঘাট ঠিক তখনই মায়ানমারে সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের উপর ধারাবাহিকভাবে চলছে নৃশংস হত্যাকান্ড ও ধর্ষণসহ লোমহর্ষক নানা রকম নির্যাতন।

মায়ানমারের এমন কোন ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র নেই, যা এখন মিডিয়ার বদৌলতে ভেসে আসছে না বিশ্ববাসীর সামনে। অথচ, বিশ্বমানবাধিকারের নেতারাএসব বীভৎসতা তা দেখেও না দেখার ভাণ করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন অবিরত। আসলে বিশ্ববাসী যুগে যুগে দেখেছে-দেখছে, তাদের একচোখে নুন আরেক চোখে তেল বেচার দ্বৈতনীতি।মুখোশপরা এসব মানুষগুলো যে কতটা বদলে যায় নিজেদের স্বার্থকে করতে চরিতার্থ তা আজ আর কারই অজানা নয়।

যদিও আমরা অনেকেই মনে করি, মায়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি তাদের নিজস্ব ব্যাপার কিন্তু এখন তা আর ওই পর্যায়ে নেই।এই রোহিঙ্গা সমস্যা পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য বিরাট হুমকির কারণ তথা বলা যায় একরকম গলারকাঁটা। এককথায়, রোহিঙ্গা সমস্যাএখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সর্বোপরি সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নেচরম মাথাব্যথার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমরা মনে করি, এই সমস্যা সমাধানে যদি বাংলাদেশ সময় থাকতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের যুক্তিযুক্ত দাবি উপস্থাপন না করতে পারে তাহলে বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়বেবাঙালি জাতি। যা হয়তো এক সময় কঠিন মাশুল দিয়ে শোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।
বিশ্ববাসী জানে, রোহিঙ্গারা মায়ানমারের বৈধ নাগরিক। এই রোহিঙ্গারা শতবছরের অধিক সময় ধরেমায়ানমারে বসবাস করছেন। (বার্মা) মায়ানমারের উন্নয়নে তাদেরও রয়েছে অসামান্য অবদান। তাছাড়া মায়ানমারের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা সংগ্রামেরনেতা অং সান’রসঙ্গে দেশ স্বাধীন করার

ক্ষেত্রেউৎপ্রোৎভাবে জড়িত ছিলেন অর্থাৎ অন্যতম সহযোগি ছিলেন উল্লেখযোগ্য রোহিঙ্গা নেতা। যারা নিজেরাও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এখনমায়ানমারের একরোখা ভ্রান্তনীতি যাই বলুক না কেনো, রোহিঙ্গারা যেমায়ানমারের বৈধ নাগরিক তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই কারো। আর মায়ানমার সরকার যদি চিৎকার করেও বলে, রোহিঙ্গারা তাদের দেশের নাগরীক নয় তাতেও কি আসে যায়? কেনো না, যা দিনের আলোর মত পরিষ্কার তা কেউ মানুক আর না মানুক এতে বিশ্ববাসীর কিছু আসে যায় না।কোনো সরকার কিংবা সামরিক শক্তির আদেশে যেমন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল কিংবা বহালের বিষয়টি নির্ধারণ করতে পারে না তেমনি নোবেল বিজয়ী সুচি তার বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে তুষ্ট করার জন্য রোহিঙ্গাদের জন্মভূমি হতে বিতাড়িত করার অধিকারও রাখেন না।
বিশ্বের কোনো শান্তিপ্রিয় মানুষ তাদের এই বর্বরতাতে মেনে নিতে পারেন না। বিশ্বের কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠী-রাষ্ট্র যদি মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে সমর্থন করেন তাহলে এটি হবে চরম ঘৃণা ও ধিক্কারের বিষয়।শুধু তাই নয়, যা অচিরেই ইতিহাসের আস্তাকুঁরেনিক্ষিপ্ত হবে তারা। সু চি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হয়েও তার রাষ্ট্রের নাগরিক সমস্যা সমাধানে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে যেঅশান্তি সৃষ্টি তথা যুদ্ধবাদী মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছেন তা বিশ্ববাসী কখনও ক্ষমা করবে না। তিনিমায়ানমারের রোহিঙ্গাদের উচ্ছ্বেদ করার জন্য যেভাবে সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছেন তা ইতিহাস কোন দিন ক্ষমা করবে না।মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর এই ববর্রতার জবাব তাকে একদিন দিতেই হবে। সু চি ক্ষমতায় আসীন হয়েমায়ানমারের সামরিক জান্তার সৃষ্ট রোহিঙ্গা জাতিগত সমস্যার যৌক্তিক সমাধান না করে উল্টো পুরনো পথেই হাঁটছেন-যা বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক নেতা যদি ক্ষমতায় আসীন হয়ে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার অভিপ্রায়ে তৈরি করে স্বৈরাচারী মনোভাব এবং বর্বরতার দিকে অগ্রসর হয় সে বেশিদিন টিকে থাকে না। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গারা মায়ানমারের কোন সমস্যার কারণ নয়; সমস্যা মায়ানমার সরকার তথা সুচি’র দৃষ্টিভঙ্গির।

মিয়ানমার সরকারকে খেয়াল রাখা দরকার,২ লাখ ৬১ হাজার বর্গমাইল আয়তনেরএইমায়ানমার দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৫ কোটি ৪৫ লাখ। যার প্রতি বর্গমাইলে মাত্র ২১৫ জন মানুষ বাস করছে। ভৌগলিক কারণেমায়ানমার রাষ্ট্রটি সম্পদশালী। এই রাষ্ট্রের রয়েছে বিশাল খনিজসম্পদ।শুধু তাই নয়, বনজসম্পদ, মৎস্য-কৃষিসহ প্রাকৃতিক সম্পদে ঘেরা এই মনোমুগ্ধকরমায়ানমার। এসব মূল্যবান সম্পদ আহরণে বিগতদিনেরোহিঙ্গাদের রয়েছে বিশাল অবদান। দেশ উন্নয়নে ভবিষ্যতেও তাদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এছাড়াজাতিগতভাবে রোহিঙ্গারা মুসলমান হওয়ায় মুসলিমবিশ্ব শ্রমবাজার তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বিগতদিনে এবং ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করে বিদগ্ধজনরা। সুতরাং মায়ানমার সরকার তথা সুচি যদি মনে করেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রোহিঙ্গাদের কাজে লাগিয়ে দেশকে আরো সমৃদ্ধের পথে এগিয়ে নেবেন তাহলেই চলমান সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
যদিও বিশ্ববাসী এখন সু চিকে ধিক্কার জানাচ্ছে; তার এহেন ন্যক্কারজনক হিং¯্র কর্মকাল্ডে নোবেল ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সরব হয়ে ওঠেছে। মিডিয়ায় ঘটা করে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর ববর্রতার ছবি ও ভিডিও দেখানো হচ্ছে কিন্তু এসব ববর্রতার বিরুদ্ধে জোরালো কোন ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না কোন ব্যক্তি-গোষ্ঠী, দেশ তথা জাতিসংঘকে। যার ফলে ক্রমেই বর্বর থেকে বর্বর হয়ে ওঠছে মায়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা এতটাই হিং¯্র হয়ে ওঠছে, যা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।

যে সেনাবাহিনী তৈরিহয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য। আর সে সেনাবাহিনী-ই এখনমায়ানমারে ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র ব্যবহার করে অমানবিক নির্যতানের মাধ্যমেনিজ দেশের নাগরিককে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাওপোড়াওসহ এমন কোন নির্যাতন নেই যা করছে না। তাদের এই বর্বরোচিত কর্মযজ্ঞে রোহিঙ্গা সমস্যা বহুমাত্রিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে এখন। ইতোমধ্যে বহু নিরীহ-নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে তারা। এ হত্যার দায়িত্ব কোনভাবেই এড়াতে পারেন না নোবেল বিজয়ী সু চি।

আমরা কি ভুলে গেছি, নিজের দেশের নাগরিক হত্যার জন্য যদি ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, ক্রোয়েশিয়ায় ও বসনিয়াতে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের হত্যার জন্য যদি সার্বিয়ার প্রেসিডেন্টের জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল আদালতে বিচারের কাঠগড়ার দাঁড়াতে হয় তাহলে একই অপরাধের জন্য সু চির বিচার হবে না কেন? এই প্রশ্ন এখন বিশ্ববাসীর। নিজেদের অপস্বার্থ হাসিলে নিরপরাধ নিরীহ-অসহায় মানুষকে হত্যার জন্য অবশ্যই জাতিসংঘ সু চিকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। এই দায়িত্ব জাতিসংঘকেই নিতে হবে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস দমন আইনে নিরীহ জনগণের বাসভূমি পোড়ানো জঘন্যতম সন্ত্রাসী অপরাধ। সন্ত্রাসবিরোধী আন্তর্জাতিক আদালত সে দায়িত্ব কোনো অবস্থাতেই এড়াতে পারেন না। রোহিঙ্গারা জন্মগতভাবে মায়ানমারের বৈধ নাগরিক এবং তা মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথনেই। হিংসাত্মক বর্বর কর্মকান্ডের মাধ্যমেমায়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে যে চক্রটি সু চিকে সামরিক সমাধানের দিকে ঠেলে দিয়েছে তারা কোনদিনইমায়ানমারের বন্ধু হতে পারে না-এটা সুচিকে বুঝতে হবে। সুচির নির্দেশে মায়ানমারের সেনাবাহিনী যেভাবে বাংলাদেশের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে দলে দলে এদেশে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিচ্ছে, তা দিনে দিনে ভয়াবহ এক অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দু’টি দেশকেই। যার ফল কখনও কারো জন্যই ভাল হবে না-হওয়ার কথা নয়। যদিও বাংলাদেশ সরকার মায়ানমার সরকারের এ নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে তেমন কোন ভূমিকা নিচ্ছেন না এবং যথেষ্ট সহনশীল-ধৈর্য ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছেন কিন্তু এতে করে মায়ানমারকে ভাববার কোন অবকাশ নেই যে বাংলাদেশ দূর্বল কিংবা তাদের এসব অনৈতিকতাকে মেনে নেবে।মায়ানমারকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জনগণ শান্তিপ্রিয়। এদেশের মানুষ সব সময় প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে বিশ্বাসী। কিন্তু তাই বলে এমন নয় যে, নিজেদের সার্বভৌমত্বেরউপর আঘাত এলে কাউকে ছেড়ে দেবে। সুতরাং বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে মায়ানমারকে।

আমরা লক্ষ্য করছি, মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীমানবিক সহানুভূতি ও ত্রাণ-খয়রাত প্রদানে এগিয়ে এসেছেন-আসছেন। অকপটে বলতে হয় হ্যাঁ, এটা প্রয়োজন রয়েছে। যা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাধুবাদ পাওয়ারও যোগ্য। কিন্তু তাতেপ্রকৃত কাজের কাজ তেমন একটা হবে বলে আমরা মনে করি না। কারণ এতে করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছু অসাধু ব্যক্তি-গোষ্ঠীর ভাগ্য খুলবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের তেমন কোনো কল্যাণ কিংবা ভাগ্যের উন্নয়ন হবে না। সাময়িকভাবে হয়তো তারা কিছুটা উপকৃত হবে। মোটকথা,রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক অঙ্গণকেই এগিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক যথাযথ পদক্ষেপই হতে পারে রোহিঙ্গাদের রক্ষা কবজ।এর কোন বিকল্প আছে বলে আমাদের জানা নেই।











(ওএস/এস/ডিসেম্বর২৪,২০১৬)