নিউজ ডেস্ক : কোনো একটি ঘটনায় আতঙ্কে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর কেন হঠাৎ করেই সেই স্মৃতি আমাদের স্মৃতিতে ফিরে আসে। আর সেই স্মৃতি কেনই-বা আজীবন আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, কেনই-বা রাতের ঘুম কেড়ে নেয় আমাদের। সেই আতঙ্কের স্মৃতিকে যাতে আর আজীবন বয়ে বেড়াতে না হয় আমাদের, তার পথ খুঁজে বের করেছেন সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায় নামে এক বাঙালি বিজ্ঞানি। যে পথ ধরে একদিন এমন ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের হাতে এসে যাবে, যাতে করে অতীতের ফিরে ফিরে আসা আতঙ্কের স্মৃতিকে ‘মুছে ফেলা’ যাবে পুরোপুরি।

ভারতের বায়োটেকনোলজি ও পরমাণু শক্তি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এই সাড়া জাগানো গবেষণাটি করেছেন তিনি। তার এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ফিজিওলজিক্যাল রিপোর্টস’-এ। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘দ্য ডিলেইড স্ট্রেংদেনিং অফ সিন্যাপটিক কানেক্টিভিটি ইন দ্য অ্যামিগডালা ডিপেন্ডস অন এনএমডিএ রিসেপ্টর অ্যাক্টিভেশন ডিওরিং অ্যাকিউট স্ট্রেস’।

সুমন্ত্র বলেন, ‘আমাদের মস্তিষ্কে পাশপাশি দুটি এলাকা রয়েছে। একটি- ‘হিপোক্যাম্পাস’। অন্যটি- ‘অ্যামিগডালা’। ভয়, আতঙ্ক, আনন্দ, দুঃখ, হতাশা- এমন নানা অনুভূতির জন্ম হয় ওই অ্যামিগডালায়। আর সেইসব কিছুর স্মৃতিকে আজীবন আগলে বাঁচিয়ে রাখে ওই অ্যামিগডালাই। কোনো স্মৃতিকেই সে চট করে মুছে ফেলতে চায় না। মুছে ফেলে না। আবার স্মৃতির ভারে খুব বেশি ‘ভারি’ হয়ে গেলে ওই অ্যামিগডালা নিজেই বেছে নেয়, কোন স্মৃতিকে সে বাঁচিয়ে রাখবে। আর কোন স্মৃতিটুকু সে মুছে ফেলবে। অনেকটা স্পুল সিস্টেমের টেপ রেকর্ডারের মতো। বাছাইটা সে নিজেই করে। প্রয়োজনে নিজেই মুছে ফেলে কিছু কিছু স্মৃতি, ‘ভারি’ হয়ে উঠতে হবে না বলে। আমরা পড়া মুখস্থ করি, টেলিফোন নম্বার, ই-মেল অ্যাড্রেস যে মনে রাখতে পারি বহুদিন। তার জন্য কৃতিত্বটা দাবি করতে পারে ওই অ্যামিগডালাই। মস্তিষ্কের টেমপোরাল লোবের অত্যন্ত গভীরে থাকা ওই অ্যামিগডালাই আমাদের মস্তিষ্কের ‘ইমোশনাল হাব’।

তিনি জানান- ‘যত রকমের অনুভূতি রয়েছে আমাদের, তার সব কিছুরই ‘স্টোরেজ’ (জমা থাকে) হয় অ্যামিগডালায়। আমরা দেখেছি, কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনার পর আমাদের আতঙ্কের স্মৃতির কিছুই থাকে না অ্যামিগডালায়। এমন আতঙ্কের ঘটনা যে ঘটেছে, তা ওই সময় যেন মনেই করতে পারে না আমাদের মস্তিষ্ক। কারণ, সেই ঘটনার ‘ফুটেজ’ অ্যামিগডালায় তখনও নেই। এই অবস্থাটা চলে ওই ভয়ঙ্কর আতঙ্কের ঘটনার ১০ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত। তার পরেই হঠাৎ করেই ‘বিগড়ে যেতে’ শুরু করে অ্যামিগডালা। তার মধ্যে নানা রকমের পরিবর্তন হতে শুরু করে, ধীরে ধীরে। আতঙ্কের স্মৃতিতে একটু একটু করে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে শুরু করে অ্যামিগডালা। আর আমরা ‘আক্রান্ত’ হতে শুরু করি অতীতের ওই ভয়ঙ্কর আতঙ্কের স্মৃতির হানাদারিতে! আমাদের মনে তখন প্রায় সব সময়ই হামলা চালাতে শুরু করে সেই আতঙ্কের স্মৃতি। ঘরে, বাইরে সর্বত্র। আচমকা। হঠাৎ হঠাৎ। সেই জন্যই ওই মহিলার গলার হার ছিনতাইয়ের ভয়ের স্মৃতি ফিরে আসে বেশ কিছু দিন পর, যখন আসলে তিনি গোটা ঘটনাটাই প্রায় ভুলে যেতে বসেছিলেন।’

সুমন্ত্র বলছেন, ‘অ্যামিগডালার ওই ভুতুড়ে আচরণের জন্য দায়ী বিশেষ একটি প্রোটিন। যার নাম- ‘এন-মিথাইল-ডি-অ্যাসপারটেট রিসেপ্টর’ (এনএমডিএ-আর)। আমাদের স্মৃতিশক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে স্নায়ুকোষের এই প্রোটিনের। ওই প্রোটিনের জন্য তখন অ্যামিগডালায় একটি স্নায়ুকোষের সঙ্গে অন্য স্নায়ুকোষের যোগাযোগ রাখার নতুন নতুন সাইন্যাপসের জন্ম হতে থাকে। সেই সাইন্যাপসগুলো গড়ে, বেড়ে উঠতে থাকে, ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর তার ফলে অ্যামিগডালার ওই অংশগুলিতে বিদ্যুৎ প্রবাহ আচমকা অনেকটা বেড়ে যায়। বাড়তি বিদ্যুৎ মানেই বাড়তি শক্তি। আর শক্তি যখন বেশি হয়ে যায়, তখন আপাতভাবে হারিয়ে যাওয়া অতীতের আতঙ্কের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনার রসদটা জোগাড় করে নিতে আর অসুবিধা হয় না অ্যামিগডালার। তাই ওই সময় অতীতের আতঙ্কের স্মৃতি ফিরে আসে অ্যামিগডালায়। আর তা রোজ ফিরে ফিরে এসে আজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আমাদের। যাকে বলে- ‘পোস্ট ট্র্যমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ (পিটিএসডি)।’’

সহযোগী গবেষক বেঙ্গালুরুর এনসিবিএসর ছাত্রী ফারহানা ইয়াসমিন দিয়েছেন তার ব্যাখ্যা। ফারহানের কথায়,-‘ঘটনার পর পরই আতঙ্কের কতটা ছাপ পড়ে অ্যামিগডালায়, এখনও পর্যন্ত স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণা শুধু সেই কারণটাই খুঁজে বেরিয়েছে। আমাদের গবেষণার অভিনবত্ব এখানেই যে, ঘটনার অত দিন পরেও কেন, কীভাবে আতঙ্কের স্মৃতি ফিরে আসে আমাদের আর তা আজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, তার কারণ খুঁজে বের করতে পেরেছি।’

আতঙ্কের স্মৃতির বহুদিন পর ফিরে আসা বন্ধ করার পথ যেভাবে দেখালেন গবেষকরা-

সুমন্ত্র বলছেন, ‘আমরা ওই প্রোটিন (এনএমডিএ-আর) তৈরি হওয়ার পথটিকে বন্ধ করে দিতে পেরেছি। এই প্রথম। আর তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আতঙ্কের ঘটনার বহু দিন পর অ্যামিগডালায় নতুন নতুন সাইন্যাপস গজিয়ে ওঠাও বন্ধ করে দিতে পেরেছি। তার ফলে বাড়তি বিদ্যুৎ শক্তির জন্মও হয়নি আর। তাই ঘটনার বহুদিন পর আর আতঙ্কের স্মৃতি ফিরে আসেনি।’

মূল গবেষণাপত্রটি দেখুন এখানে physreports.physiology.org ।

উল্লেখ্য, সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি ভারতের কলকাতায়। তিনি বেঙ্গালুরুর ‘দ্য ইনস্টিটিউট ফর স্টেম সেল বায়োলজি অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিনে’র ‘সেন্টার ফর ব্রেন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিপেয়ার’র কর্মকর্তা।

তিনি অধ্যাপনা করছেন- ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস’ (এনসিবিএস)-এ।

(ওএস/এএস/জানুয়ারি ০৭, ২০১৭)