বাহালুল মজনুন চুন্নু


ঐ মহামানব আসে/দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে/সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,/নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক—/এল মহাজন্মের লগ্ন। /আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।

/উদয় শিখরে জাগে ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’/নবজীবনের আশ্বাসে। /‘জয় জয় জয়রে মানব-অভ্যুদয়’/মন্দ্রি-উঠিল মহাকাশে শান্তিনিকেতনে শয্যাশায়ী অবস্থায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখে মুখে রচিত হওয়া এই গানটি ঠিক ৪১ বছর পর বাঙালির হৃদমন্দিরে বীণার ঝংকার তুলেছিল। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে, তাঁর অনুপ্রেরণা-আদর্শে উজ্জীবিত বাঙালির মরণপণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির আজন্ম লালিত স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, সেই তিনি দীর্ঘ ২৯০ দিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ আর মৃত্যুর প্রহর গোনার পর যখন বিজয়ী বেশে বাঙালির কাছে ফিরে আসেন, তখন তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য রবীন্দ্রনাথের ওই গানের কলিগুলো হয়ে ওঠে যথার্থ স্বাগত সংগীত। দীর্ঘ ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলার আকাশে লাল-সবুজে খচিত বিজয় নিশান উড়লেও বাঙালিরা বিজয়োল্লাসে মেতে উঠতে পারেনি, বরং তাদের অন্তর অজানা ভয়, শঙ্কায় কুঁকড়ে গিয়েছিল। কারণ তাদের জাতির পিতা তখনো তাদের কাছে ফিরে আসতে পারেননি। তাঁর অনুপস্থিতি শেলের মতো বিঁধে চলছিল বাঙালির বুকে, নিদারুণ পীড়া নিয়ে পিতার মঙ্গল কামনায় ব্রত হয়েছিল তারা। তাই ১০ জানুয়ারি তিনি যখন বিজয়ী বেশে ফিরে এলেন এই বাংলায়, সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটি বাঙালির জীবনে হাজির হলো এক অনিন্দ্য মহাকাব্যিক চিত্রপট এঁকে। আর এর মধ্য দিয়েই পূর্ণতা পেল স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ার্জন। বাংলার বুকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো সংগ্রামী মানুষের চূড়ান্ত বিজয়ের তূর্যনাদ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের তীব্র ভালোবাসা দেখে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বলেছিলেন, বাঙলা দেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রসূর্ত রাজ/প্রতি বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত তাজ।

ভয়াল ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার প্রাক্কালে হানাদার বাহিনী জাতির পিতাকে তাঁর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে তাঁকে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। কিন্তু সৌভাগ্য, গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই জাতির পিতা দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে বন্দি করে ইয়াহিয়া শুরু করেছিল তামাশার বিচার। উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে ভয় দেখিয়ে আপসে বাধ্য করা আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে খুশি করা। বঙ্গবন্ধুকে মানসিক চাপে ফেলার জন্য তাঁর সেলের পাশে তাঁর জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অন্য ধাতুতে গড়া। বিচারে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে চাইলে তিনি নির্ভয়চিত্তে বলেছিলেন, ‘আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিও। ’ পাকিস্তান বাহিনী বাঙালিদের কাছে নাকানিচুবানি খেতে খেতে যখন পুরো বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল তখন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ইয়াহিয়া ১৫ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির পিতার ফাঁসির আদেশ কার্যকরের আদেশ দেয়। কিন্তু জাতির পিতা ছিলেন নির্ভয়। তিনি শুধু ভাবছিলেন তাঁর বাংলার জনগণের মুক্তির কথা। ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য মাথানত করে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আন্তর্জাতিক নেতাদের চাপের কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। ৮ জানুয়ারি বিবিসিতে প্রচারিত হলো বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর। আর সঙ্গে সঙ্গে আনন্দোল্লাসে মেতে উঠল পুরো জাতি। সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণোচ্ছলতায় ঝলমলে হয়ে উঠল স্বাধীনতার স্বর্ণ-সূর্য, লাল-সবুজের বিজয় পতাকা। পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধু লন্ডন-দিল্লি হয়ে ঢাকায় পৌঁছেন এর দুই দিন পরের রৌদ্র ঝলমলে দুপুরের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে।

যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত দেশে অস্থির, অনিশ্চিত ও অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। চারদিকে ধ্বংস আর বিনাশের চিহ্ন। সর্বত্র হাহাকার, ক্রন্দন ধ্বনি। নেতৃত্ব সংকটে অমানিশার অন্ধকারে সদ্য স্বাধীন দেশের সবাই দিশাহারা। চারদিকে নেই, নেই আর নেই। এমনতর পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যায়। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সেই সময়টায় এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল যে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর ও সেটার গুরুত্ব ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল দেশি-বিদেশি প্রায় সব গণমাধ্যমে। কাব্য, মহাকাব্য রচিত হয়েছিল পত্রপত্রিকায়। টাইম ম্যাগাজিন লিখেছিল, ৯ জানুয়ারি দিনটি ছিল রবিবার। বাংলাদেশের সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যে সারা দেশ আনন্দ-উল্লাসে উত্তাল। অধীর আগ্রহে সবাই অপেক্ষা করছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের। বিধ্বস্ত যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যেও লোকজন ছুটতে শুরু করেছে ঢাকার দিকে। ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়তে লেখে, ‘বঙ্গবন্ধুর মুক্তি বাংলাদেশকে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছে। ’ দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, আজাদী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব পত্রিকায় প্রধান প্রতিবেদনই ছিল বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে।

আর অন্যদিকে প্রাণপ্রিয় নেতাকে বরণের জন্য, একনজর দেখার জন্য, তাঁর ধ্রুপদী বাণী শোনার জন্য ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লাখ লাখ মানুষ সমবেত হয় সেদিন রেসকোর্সের ময়দান, এয়ারপোর্ট রোড আর তেজগাঁও বিমানবন্দরে। ‘তোমার পথের প্রান্তে মনের মণিদীপ জ্বেলে রেখেছি’ এই সুর যেন বেজে চলছিল অপেক্ষমাণ জনতার হৃদয়ের গহিনে। বঙ্গবন্ধুর জন্য মানুষের অন্তরে কী প্রগাঢ় ভালোবাসা জমে উঠতে পারে, ওই দিনের জনসমাগমের ব্যাকুলতা-ব্যগ্রতার সে দৃশ্য না দেখলে বোঝানো দুষ্কর। দুপুরের দিকে ঢাকার আকাশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট জেট চক্কর খেল। জাতির পিতা আকাশ থেকে তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিকে দেখতে চাওয়ায় পাইলট প্রায় ৪৫ মিনিট বাংলার আকাশ তাঁকে ঘুরিয়ে দেখান। এরপর বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দর স্পর্শ করে বিকেল ৩টার দিকে। ২১ বার তোপধ্বনি আর লাখো মানুষের আনন্দোল্লাসের মধ্য দিয়ে জাতির পিতাকে বরণ করল তাঁর অতি প্রিয় মাতৃভূমি। বঙ্গবন্ধু যখন বিমান থেকে বের হয়ে এলেন তখন তাঁকে দীর্ঘ কারাবাসের কারণে রোগাটে, ক্লান্ত কিন্তু আশ্চর্য রকম প্রাণবন্ত মনে হচ্ছিল।

বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানালেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিপরিষদ। হাত মেলালেন ভারত ও ভুটানের হাইকমিশনারদ্বয়, ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার, রাশিয়ার কনসাল জেনারেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ড ডি স্পিভাকওসহ অন্যান্য দেশের কূটনীতিকরা। এরপর বঙ্গবন্ধু হেঁটে গেলেন ছোট একটি মঞ্চে। প্রাক্তন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টস ও মুক্তিবাহিনী তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করল। বিমানবন্দরে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত

বক্তব্য দেওয়ার কর্মসূচি ছিল, কিন্তু প্রবল ভিড়ের কারণে সেই কমর্সূচি বাতিল হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু লাল-নীল রঙের একখানা খোলা ট্রাকে উঠে পড়েন। বাঙালি জাতির প্রাণোচ্ছ্বাস দেখে আবেগে আপ্লুত তিনি রুমাল বের করে চোখ থেকে আনন্দাশ্রু মুছতে লাগলেন। হাসলেন। খুব হালকা করে জনতার দিকে হাত নাড়তে লাগলেন। ধীরে ধীরে ট্রাকটি অতি ধীর ও শান্তভঙ্গিতে রমনা রেসকোর্স মাঠের সংবর্ধনা সভার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। তেজগাঁও থেকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের দূরত্ব খুব বেশি নয়। অথচ এই অল্প একটু পথ অতিক্রম করতেই লেগে গেল প্রায় ঘণ্টা দুয়েক। পুরো রাজপথেই জনতার ঢল। কেউ বাদ্য বাজাচ্ছে। কেউ নাচছে। কেউ গান গাইছে। মুহুর্মুহু স্লোগান আর জনতার ছুড়ে দেওয়া পুষ্পবৃষ্টিতে স্নাত জাতির পিতার হাস্যোজ্জ্বল মুখটিই বলে দিচ্ছিল, তিনি পরিপূর্ণ তৃপ্ত এক মানুষ।

বিমানবন্দর, রাজপথের মতো রেসকোর্স ময়দানও জনসমুদ্র। তিল ধারণেরও কোনো ফাঁক নেই। বঙ্গবন্ধু ট্রাক থেকে নেমে নৌকাসদৃশ সভামঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। নির্মলেন্দু গুণের মতো বলতে হয়, ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। /তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,/হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?’ জনসমুদ্রের বাঁধভাঙা জোয়ার, অকৃত্রিম ভালোবাসা-শ্রদ্ধা আর তাদের মুহুুর্মুহু হর্ষধ্বনি শুনে পিতার চোখ বেয়ে নেমে এলো আনন্দাশ্রুর ধারা, যে ধারা সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ে মিশে তাদের দেখাল নবজীবনের রঙিন স্বপ্ন। ভাষণে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রবীন্দ্রপ্রেমী বঙ্গবন্ধু বললেন, “বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি। ’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার আক্ষেপ আমরা মোচন করেছি। তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। হে বিশ্বকবি, তুমি আজ জীবিত থাকলে বাঙালির বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে নতুন কবিতা সৃষ্টি করতে। ” সেদিন প্রায় ১০ লাখ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি দিলেন সেই ধ্রুপদী ঘোষণা, ‘রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাঙালি জাতির এই ভালোবাসার ঋণ শোধ করে যাব। ’ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কর্মের কারণে শুধু বাঙালি জাতিই নয়, সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আজও অনুপ্রেরণা, শ্রদ্ধা-ভালোবাসার এক নাম, থাকবেন চিরকাল অনির্বাণ।


লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

কৃতজ্ঞতা : দৈনিক কালেরকন্ঠ