জাপান প্রবাসী বাংলাদেশী লেখক ও গবেষক প্রবীর বিকাশ সরকারের লেখা গ্রন্থ  ”রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক”  নিয়ে  দীর্ঘ আলোচনা করেছেন পশ্চিম বঙ্গের প্রখ্যাত লেখক-গবেষক সুরজিত  দাশগুপ্ত। তাঁর এই লেখাটি প্রকাশ 'বিসারী' নামের একটি সাহিত্য সাময়িকীতে। রবীন্দ্র ভক্তদের জন্য ওই আলোচনাটি উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল।

রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান
সুরজিৎ দাশগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথের উপরে পাশ্চাত্য প্রভাব, রবীন্দ্রনাথ ও ইউরোপ, অথবা রোদেনস্টাইন-আইনস্টাইন, কিংবা রবীন্দ্রনাথ ও রাশিয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা চোখে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ভ্রমণের কথাও আমরা বিশদভাবে জানি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনি ‘দ্বীপময় ভারত ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্যামদেশে’ গ্রন্থখানির দৌলতে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এশিয়ার আরও তিনটি দেশে অর্থাৎ চীনে, জাপানে ও পারস্যেও গিয়েছিলেন। সেসব দেশে কাদের সুবাদে গিয়েছিলেন, কাদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয় হয়েছিল, কাদের কাছে আতিথ্য ও সমাদর পেয়েছিলেন, সেসব দেশে রবীন্দ্রচর্চার বর্তমান অবস্থা কী এসব বিষয়ে আমরা খুব অল্পই জানি। রবীন্দ্রনাথ ও এশিয়া নিয়ে গভীর অনুসন্ধান, বিস্মৃত আলোচনা তথা গবেষণার সুবিশাল ক্ষেত্র অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশের মতো পড়ে আছে।

এই বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হাতে এল জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশী প্রবীর বিকাশ সরকারের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক’ বইটি। বইটির শুরুতেই লেখক নগেন্দ্রনাথ দত্তকে ১৩২৩ সালের ৩রা আষাঢ় রবীন্দ্রনাথ যে চিঠি লিখেছিলেন তার থেকে উদ্বৃতি দিয়েছেন, ‘এত আজ¯্র আদর অভ্যর্থনা আমার জীবনে আর কোথাও পাইনি।’ আশ্চর্যের বিষয় বিশ্বভারতীর রবীন্দ্ররচনাবলী ১৯ খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ‘জাপানযাত্রী’র গ্রন্থ পরিচয় অথবা ‘রবীন্দ্রজীবনী’ ২য় খণ্ডে এই চিঠির কোনও উল্লেখ নেই। এ বই পড়ার আগে খেয়ালই করিনি যে, রবীন্দ্রনাথ মোট পাঁচবার জাপানে গিয়েছিলেন--প্রথমবার ১৯১৬ সালের ২৯ শে মে থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর অর্থাৎ প্রায় তিন মাস, দ্বিতীয়বার ১৯১৭ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে দিন কয়েক, তৃতীয়বার ১৯২৪ সালের মে মাসের শেষ দিকে পৌঁছে জুন মাসের শেষ দিকে জাপান ছাড়লেন অর্থাৎ প্রায় এক মাস, চতুর্থবার ১৯২৯ সালের ২২ শে মার্চ থেকে ২৮ শে মার্চ মানে এক সপ্তাহ এবং ১০ই মে থেকে ৮ই জুন অর্থাৎ প্রায় তিন সপ্তাহ, তা হলে সাকুল্যে ৫ মাস ১০দিন।

রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ পক্ষকাল ছিলেন রাশিয়াতে। তাঁর এই পক্ষকাল রাশিয়াবাস নিয়ে আমাদের যে আগ্রহ তার তুলনায় আমাদের কতটুকু আগ্রহ জাপানে রবীন্দ্রনাথের পাঁচ মাস দশ দিন সম্বন্ধে? নিজের প্রতি আরও ধিক্কার আসে এজন্য যে আমাদের বড় মাসিমা হরিপ্রভা তাকেদা রবীন্দ্রনাথের আগে ১৯১২ সালে জাপান গিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ও জাপানে ছিলেন এবং টোকিও রেডিও থেকে বাংলায় খবর পড়তেন আর তাঁর সময়ও ‘বঙ্গমহিলার জাপানযাত্রা’র নতুন সংস্করণ ঢাকা থেকে ও নতুন পরিবর্ধিত সংস্করণে কলকাতার ডি এম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আমার পক্ষে জাপানে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে উদাসীনতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ!

জাপান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের সূচনা হয় ১৯০২ সালে ওকাকুরার কলকাতায় আসা থেকে। ‘রবীন্দ্রজীবনীকার’ প্রভাতকুমার যদিও ওকাকুরার নাম ‘কাকুজো’ লিখেছেন তবু প্রবীর বিকাশ জানিয়েছেন যে ওকাকুরা ১৯০৭ সালে ‘কাকুজো’ নামটা ছেড়ে ‘তেনশিন’ নামটা গ্রহণ করেন এবং এখন সবাই তাঁকে তেনশিন ওকাকুরা নামেই চেনে। জাপানে যখন নতুন সূর্যের যুগ শুরু হয় তার ঠিক আগে স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্মসভায় হিন্দুধর্মের জয় নিশান উড়িয়ে দেন। হিন্দুধর্মের জয় পতাকার অর্থ এশিয়ার জয় পতাকা। ওকাকুরা তখন ‘Asia is One’ নামে আপ্তবাক্য লিখে এক আন্দোলন শুরু করেন আর সেই সুবাদে বিবেকানন্দ ও নিবেদিতার টানে চলে আসেন কলকাতায়, আসার পরে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এবং সুবাদে ঠাকুর পরিবারের অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়, এমনকী কবি প্রিয়ম্বদা দেবীর সঙ্গে এক বিশেষ সম্পর্কও গড়ে ওঠে। ওকাকুরা তেনশিন স্মৃতি জাদুঘরে প্রিয়ম্বদার লেখা চৌদ্দটি চিঠি আর বিশ্বভারতীতে তেনশিনের লেখা উনিশটি চিঠির সন্ধান পেয়েছেন গ্রন্থকার। ১৯১২ সালে তেনশিন ওকাকুরা আবার কলকাতায় আসেন। ১৯০২ সালে ভারতভ্রমণ শেষে ফিরে গিয়ে টোকিও তেইকোকু বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা অবলম্বনে দুঘণ্টাব্যাপী এক বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতা শুনে অভিভূত হন প্রভাবশালী আমলা ও শিল্পপতি শিবুসাওয়া এইইচি।

১৯০৩ সালে ‘জাপান-ভারত অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার তৃতীয় সভাপতি ছিলেন শিবুসাওয়া এবং সেই পদাধিকারবলেই প্রথম নোবেল পুরস্কারবিজয়ী এশীয় রবীন্দ্রনাথকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন জাপানে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গেলেন অ্যান্ড্রুজ, পিয়ার্সন ও মুকুল দে। রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা জানানো হয় টোকিওর বর্তমান জেআর ওজি রেলস্টশনসংলগ্ন শিবুসাওয়ার আসুকায়ামা গ্রীষ্মাবাসে। সেটাই এখন হয়েছে শিবুসাওয়া জাদুঘর। দোভাষীর মাধ্যমে তাঁরা আলাপ করেন। তাঁদের আলাপের বিষয় ছিল আধ্যাত্মিক ও আত্মিক সম্পর্ক নিয়ে। জাপান-ভারত অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটি বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উপহার দেওয়া হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সঙ্গীদের এবং শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের জন্য ২৫০০ ইয়েন চাঁদা। কিন্তু এই যাত্রাতে রবীন্দ্রনাথ বাস করেছিলেন প্রধানত য়োকোহামার বিখ্যাত সানকেইএন বাগানবাড়িতে। মেইজি-তাইশোও যুগের বিখ্যাত সিল্ক ব্যবসায়ী তোমিতারোও হারা এই বাগানবাড়িটি ১৯০২ সালে নির্মাণ করেছিলেন। জাপানি ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের এক দৃশ্যময় বাড়ি। এই বাগানবাড়ির মধ্যে ছিল কয়েকটি জাপানি রীতির গৃহ এবং প্রত্যেকটি গৃহের এক-একটি নাম। বাগানবাড়ির মধ্যে ছোট ছোট বন, কোনওটা পাইনের, কোনওটা সিডারের, কোনওটা মেপলের, কোনওটা বাঁশের, কোথাও পুকুরে নৌকো ভাসছে, কোথাও ফুটে আছে রাশি রাশি পদ্ম। এখানে রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালের ১৮ই জুন থেকে ২রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৬ দিন বাস করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, এই সানকেইএন বাগানবাড়ির সঙ্গে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণের আশ্চর্য সাদৃশ্য। তবে কি রবীন্দ্রনাথ সানকেইএনে আড়াই মাস থাকার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে উত্তরায়ণের পরিকল্পনা করেছিলেন? অবশ্য প্রবীর বিকাশ জানিয়েছেন সেই সানকেইএন আর নেই, ১৯২৩ এর ভয়াবহ ভূমিকম্পে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে তার অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে।

রবীন্দ্রনাথের জাপান আগমন উপলক্ষে বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে ও সাময়িকীতে প্রচুর লেখালেখি আর ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়, তা ছাড়া প্রকাশিত হয় ১৯১৬-র ৩রা জুলাই একটি ২৮২ পৃষ্ঠার স্মারকগ্রন্থ, গ্রন্থটির নাম ‘শিসেই তাগো-রু’ অর্থাৎ ‘ঋষি টেগোর’। এই একেবারেই দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থে--‘রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক’ গ্রন্থ থেকেই উদ্বৃতি দিই--‘সর্বমোট ‘৬টি বক্তৃতাধর্মী প্রবন্ধ, গীতাঞ্জলি থেকে অনূদিত একাধিক কবিতা, নয়টি দুর্লভ আলোকচিত্র, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত চারটি এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত একটি চিত্র মুদ্রিত আছে। গ্রন্থটিকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছে ভ্রমণসঙ্গী কিশোর চিত্রশিল্পী মুকুল দের স্বহস্তে অঙ্কিত সংস্কৃত ভাষার একটি বাণী। প্রবন্ধগুলো লিখেছিলেন তৎকালীন ইম্পেরিয়াল বর্তমানে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপকবৃন্দ ছাড়াও ধর্মীয় পুরোহিত, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা। এছাড়া রয়েছে রবীন্দ্রনাথের তিনটি বক্তৃতা যা ঐ ১৬টি প্রবন্ধের অন্তর্গত যথাক্রমে ‘জাপান ও ভারত’, ‘জাপানের প্রতি ভারতের কর্তব্য’ এবং ‘হে জাপান তোমার কাছে প্রত্যাশা।’ শিররোনাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে কতখানি তাৎপর্য বহন করছে রচনাগুলো। কোনও কোনও সংবাদপত্রে এগুলো প্রকাশিত হয়েছিল যেমন কলকাতার মডার্ন ইন্ডিয়া এবং জাপানের দৈনিক য়োমিউরিশিম্বুন।’ উদ্বৃতির শেষবাক্যে ‘মডার্ন ইন্ডিয়া’ নামটি কি ‘মডার্ন রিভিউ’ হবে?

সানকেইএনে থাকাকালে অকিয়ো নামের একটি তরুণীর সঙ্গে মুকুল দের ঘনিষ্ঠতা হয়। জাপানের শিল্পকলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য তোমিতারোও হারার কাছ থেকে তিনি বৃত্তি পাওয়ার কথা ছিল। জাপান থেকে রবীন্দ্রনাথের আমেরিকা যাওয়ার কর্মসূচি ছিল। তাঁর এক সঙ্গী পিয়ার্সন চেয়েছিলেন মুকুল দে জাপানে থেকে জাপানি শিল্পে আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠুক। ‘রবীন্দ্রজীবনীকার’ প্রভাতকুমার লিখেছেন, ‘কিন্তু কবি তাহাকে একাকী জাপানে রাখিয়া যাইতে রাজি হইলেন না। কবি প্রথমে ভাবিয়াছিলেন মুকুলকে অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে দেশে ফেরত পাঠাইবেন, পরে ভাববিলেন--“সে পৃথিবীটা দেখে নিক, তা হলে মানুষের মতো হয়ে উঠবে....আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে ও তৈরি হয়ে উঠতে পারবে।” অবশেষে সকলে মিলিয়াই আমেরিকা যাত্রা করা স্থির হইল।’ প্রবীর বিকাশ লিখেছেন, ‘তাতে করে মুকুল দে মনঃক্ষুণ্ন হলেও গুরুদেবের আদেশ মেনে নিতে বাধ্য হন।’

সানকেইএনে রবীন্দ্রনাথের দোভাষী ছিলেন টোকিও চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ প্রভাষক য়ুকিও ইয়াশিরোও। পরবর্তীকালে তিনি শিল্পকলার ঐতিহাসিকরূপে বিখ্যাত হন। তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়--প্রবীর বিকাশ জানিয়েছেন, ‘এই প্রথম সাক্ষাতে যখন ভারতীয় রীতিতে করজোড়ে আমাকে সম্ভাষণ জানালেন তখন তাঁকে আমার মনে হয়েছিল সুবিখ্যাত কোনও চিত্রকর্মে দেখা প্রাচ্যদেশীয় কোনও ঋষি যেন!......তারপর উঁচু পাইন বনের মধ্যে অবস্থিত ‘শোওফুকাকু’ নামাঙ্কিত তোমিতারোওর বাসভবনে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে তাঁকে নিয়ে গেলাম। কক্ষের কপাট সরানো মাত্রই অবারিত নীল আকাশ আর সমুদ্রপৃষ্ঠ উন্মুক্ত হয়ে গেল।.....ঠিক এই সময়ে একটি ছোট্ট পাখি বাতাসের তোড়ে কক্ষে ঢুকে কয়েক মুহূর্ত উড়ে উড়ে বাইরে চলে গেল।.....কবি বললেন, ‘পাখিটি আমাকে সম্ভাষণ জানাতেই এসেছিল।”

আগেই বলেছি, ১৯১৭-র জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে কয়েক দিনের জন্য রবীন্দ্রনাথ জাপানে গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করে জাপানি ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কাছে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এমনকী আমেরিকায় এমন কথাও রটে যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে এবং তাঁর নিরাপত্তার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সি তৎপর হয়ে ওঠে। এই রটনার মূলে ছিল বিষম সিং মন্ডু নামে রবীন্দ্রভক্তের উদরে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের হামলা। আমেরিকা থেকে রবীন্দ্রনাথ ২১ শে জানুয়ারি রওনা দিয়ে পথে কয়েকদিন জাপানে কাটিয়ে মুকুল দেকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় পৌঁছালেন মার্চ মাসে।

আবার ১৯২৪ সালের ২১ শে মার্চ রবীন্দ্রনাথ চীন ও জাপান অভিমুখে ভারতবর্ষের বাইরে শান্তিনিকেতনের বাণীকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং বিশ্ববাণীকে শান্তিনিকেতনে বহন করে আনার জন্য যাত্রা করলেন। এবার তাঁর সঙ্গে বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে ক্ষিতিমোহন সেন ও নন্দলাল বসু, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অধ্যাপক ডক্টর কালিদাস নাগ এবং সেক্রেটারি হিসেবে এলমহার্স্ট যান এই ভ্রমণে। তাঁরা চীন ভ্রমণের পরে ১৯২৪ সালের ৩১ শে মে নাগাসাকি বন্দরে পৌঁছান। সেখানে তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানান শ্রীমতী তোমিকো বা তোমি ওয়াদা, যিনি ১৯২৯ সালে বিয়ের পর হন তোমি কোরা। তিনিই আসাহিশিম্বুন পত্রিকাকে অনুরোধ করে জাপানের বিভিন্ন স্থানে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার ব্যবস্থা করে সেবারকার ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন। এখানে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে বলেছেন প্রবীরবিকাশ। রবীন্দ্রনাথ এসে নামেন কোবে বন্দরে ৪ঠা জুন এবং কুরাবু কসমেটিক্স কোম্পানির কর্তা নাকায়ামা তাইচি অভ্যর্থনা জানান তাঁকে। তাইচি ওই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯০৩ সালে এবং কোম্পানির একশ বছর উপলক্ষে ২০০৩ সালে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের কথা ও ছবি আছে। ওই গ্রন্থ অনুসারে রবীন্দ্রনাথের এবারকার ভ্রমণের আয়োজন করেছিল দি টেগোর সোসাইটি অব কোবে। রবীন্দ্রনাথ কোবে বন্দরে পৌঁছান ৪ঠা জুন। এবং তাইচি প্রতিষ্ঠিত অভিজাত তাইয়োওকাকু অতিথিশালায় কয়েকদিন বিশ্রাম করেন। এই সময় তাইচি প্রতিদিন সকাল-বিকাল রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে ধ্যানীর মতো চুপ করে বসে থাকতেন। ইতোমধ্যে তাইচি আরও কতকগুলো ব্যবসা ও কারখানা খুলেছিলেন। এ ছাড়াও নাকায়ামা গবেষণাকেন্দ্র, দপ্তরিখানা, ‘জোসেই’ নামে ফ্যাশন পত্রিকা, পুরাতোন শা নামে গ্রন্থ প্রকাশনালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা বা সূচনা করেছিলেন। পুরাতোন প্রকাশনালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের ২৩টি বক্তৃতার সংকলনও প্রকাশিত হয়। সংকলনটির নাম ‘ইনিশিয়ে নো মিচি’ বা ‘পুরনো পথ’ অথবা ‘নিজস্ব ধারা’ কিংবা ‘ঐতিহ্যের পথ।’ যখন রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ সালে পঞ্চম বা শেষবার জাপানে যান ও বিখ্যাত শিল্পপতি ও শিক্ষাবিদ ড.ওওকুরা কুনিহিকোর টোকিওতে অবস্থিত মেগুরো শহরের বাসভবনে থাকেন তখন তাইচি আবার কবির সঙ্গে দেখা করতে এসে কতক্ষণ কাটিয়ে যান।

কোবেতে রবীন্দ্রনাথ তিন দিন কি চার দিন কি পাঁচদিন ছিলেন এই নিয়ে সংশয় আছে। প্রবীর বিকাশ এই বিভ্রান্তিরও ঠিক উত্তর না পেয়ে লিখেছেন, ‘তবে যে কদিনই হোক না কেন রবীন্দ্রনাথ এখানে অবস্থান করার কারণে তাঁর উষ্ণমধুর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। নিবিষ্টমনে শ্রবণ করেছিলেন গুরুদেবের একাধিক বক্তৃতাও। কবিগুরুর প্রতি তিনি মনে হয় সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর নারীবিষয়ক চিন্তাভাবনার কারণে। রবীন্দ্রনাথ সেবার জাপানের কোবে, নারা, কিয়োতো, ওসাকা ও টোকিওতে যতগুলো বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার মধ্যে নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তেমনি একজন রবীন্দ্রভক্তের কথা জানা যায় তিনি হলেন শ্রীমতী নাকাগাওয়া কিনুকো। ....মাত্র চার বছরের সময় কিনুকো তাঁর পিতামাতার সঙ্গে কোবে শহরের ইয়ামাতো রোকু-চৌমে স্থানে অবস্থিত সেইনেনকান ভবনে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনেছিলেন। .....তাঁর পিতা শিল্পী মুরাকামি কাগাকু রবীন্দ্রনাথের একটি ছবিও এঁকেছিলেন, আজও সেটা সযত্নে সংরক্ষিত হচ্ছে শিল্পীর স্বগৃহে।

একটু আগে তোমি ওয়াদার প্রসঙ্গে লিখেছি যে তাঁর স্মৃতিকথা অনুসারে তিনিই রবীন্দ্রনাথের ১৯২৪ সালে জাপান ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। প্রবীর বিকাশ জানিয়েছেন তিনি জাপানে সুপরিচিত মাদাম কোরা নামে। তিনি যখন জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, ১৯১৩ সালে তাঁর শিক্ষক ড.নারুসেই জিনজোও ক্লাসে একদিন উচ্ছ্বসিতভাবে ঘোষণা করেন একজন এশীয় কবির নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর, প্রাপকের নাম রবীন্দ্রনাথ টেগোর। যখন ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ জাপানে গেলেন তখন তোমি ওয়াদা ও তাঁর সহপাঠী তানিকাওয়া তেৎসুজোও (ইনি পরে দার্শনিক রূপে বিখ্যাত হন) স্টেশনে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যান। সেবার রবীন্দ্রনাথ ইউরোপিয়োনাইজড্ জাপানকে দেখতে চাননি, চিরন্তন জাপানকে দেখতে চেয়েছিলেন। তাই স্টেশন থেকে ঘোড়ায়টানা জুড়িগাড়িতে চড়িয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। নাগানো জেলার কারুইজাওয়া শহরে জাপান মহিলা মহাবিদ্যালয়ে যান, সেখানে বক্তৃতার সঙ্গে কবিতাও আবৃত্তি করেন এবং তাঁর আবৃত্তি শুনে তোমি ওয়াদার মনে হয়েছিল ‘মন্দিরে বাজানো সুরেলা মৃদুতরঙ্গসৃষ্ট ঘণ্টাধ্বনির মতো যা একবার উপরে উঠে আবার নিচের দিকে নেমে যায়।’ কবির ভাষণটিও তোমিকোর তরুণমনে গভীর রেখাপাত করেছিল।

কারুইজাওয়াতেও রবীন্দ্রনাথ দিন দশেক ছিলেন। সেখানে কীভাবে তোমি ওয়াদা রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন সেকথা তিনি স্মৃতিকথাতে যা লিখেছেন প্রবীর বিকাশ তার জাপানি থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন--‘কবি মাউন্ট আসামার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি ভীষণ অনুরক্ত হয়ে পড়েন। পাহাড়ের উঁচু উঁচু স্থানে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মধ্যে তাঁর যে ধ্যান--সেই ধ্যানসমগ্রতার ভেতর থেকে অসংখ্য সুন্দর কবিতার জন্ম হয়েছিল। ঋষিকবির আসনযুক্ত কোলের ওপর রক্ষিত কবিতার খাতায় ‘দিকভ্রান্ত ছোট্ট পাখি’, ‘জোনাকি’, ‘করবীগাছ’ প্রভৃতি কবিতা একটার পর একটা লিখেছেন। প্রতিদিন সকালে কবি কুয়াশায় বিচ্ছুরিত বুনোফুলে সজ্জিত ছাত্রীদের গৃহে প্রাতঃরাশ গ্রহণে এসে নির্ভুলভাবে সদ্যরচিত সেসব মুক্তোসম বাংলা ভাষা থেকে সহজ করে ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনাতেন। .....ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই ইংরেজি বুঝতে অক্ষম ছিল, আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলাম বিধায় কবিতাগুলো খাতায় লিখেছিলাম, পরে সেগুলো অনুবাদ করে সহপাঠীদের শুনিয়েছি।....ঠাকুর মহাশয় বর্ণিত ধ্যানের অর্থ, তার রীতি, আত্মার স্পন্দন; তারপর ব্রহ্ম ও মানবের সম্পর্ক--এই রকম বিষয় বাস্তবে আমার অভিজ্ঞতালবদ্ধ না হলেও হৃদয়ের মধ্যে কম্পনতুল্য মর্মস্পর্শী গভীর জিনিস বলে মনে করি।’

তোমি কোরা আরও লিখেছেন, ‘ঠাকুর মহাশয় যেদিন তেনশিন ওকাকুরার সমাধি পরিদর্শনে ইজুরা চলে যান সেদিন ছিল কারুইজাওয়াতে অবস্থানের দশম দিনের রাত। নৈশ ট্রেনে উপবিষ্ট তাঁকে বিদায় দিতে আমরা প্রত্যেকে হাতে ছোট ছোট লণ্ঠন নিয়ে গিয়েছিলাম এবং তাঁর বিদায়ের ব্যথায় ব্যথিত হয়েছিলাম। সকলেই ছিলাম বয়সে তরুণ তাই হয়তো বা দ্বিতীয়বার আর কখনো দেখা হবে না এই ভেবে কিছুতেই চোখের জল সংবরণ করতে পারছিলাম না।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আরও কয়েকবার মাদাম কোরার দেখা হয়। তিনি জাপানে শিক্ষার পাট শেষ করে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯১৮ সালে চলে যান আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯২০ সালের অক্টোবরে নিউইয়র্ক যান (প্রবীর বিকাশ ভুল করে লিখেছেন ১৯১৯ সাল) তখন আবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয় এবং তখন মাদাম কোরা কবিকে আশ্বাস দেন যে এবার জাপানে এলে তিনি রবীন্দ্রনাথের জন্য বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতার ব্যবস্থা করবেন।

আগেই বলেছি ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জাপানে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বিভ্রান্তি আছে। চীন ভ্রমণ সেরে রবীন্দ্রনাথ জাপানে গিয়ে প্রথম পৌঁছান নাগাসাকি বন্দরে। নাগাসাকিতে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান মাদাম কোরা। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন জাহাজে চড়ে কোবে, য়োকোহামা প্রভৃতি স্থানে যেতে, কিন্তু তোমি কোরা জানালেন, তা হলে জাপান দেখা হবে না। তারপর জোর করে কবিকে নাগাসাকিতে নামালেন, কবি ও তাঁর দলবলকে নিয়ে গেলেন প্রথমে উনজান নামক শহরে, সেখানকার প্রাকৃতিক শোভা দেখে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত! তারপর পর্যটন শহর হাতাকাতে, এরপর মিয়াজিমা দ্বীপে, অবেশেষে কোবেতে। এবারকার জাপান ভ্রমণে তোমি কোরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দোভাষী ও পরিচালিকা হিসেবে গুরুদেবের সঙ্গে ছিলেন। সেটা জুন মাস, আমের সময়। তোমি কোরা প্রতিদিন আম জোগানের ব্যবস্থা করে তাঁকে একেবারে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাখ ভারতে ফিরে যাবার পরে তোমি কোরা যখন আপন কর্মস্থল ফুকুওকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে যান তখন কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছে কৈফিয়ত চায়, ছুটি নিয়ে সংবাদপত্রের সংবাদ হয়ে ওঠার অর্থ কী? আরও নানা দিক থেকেই নানা প্রশ্ন তাঁকে শুনতে হয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত এইসব চর্চার পরিণাম হল জাপান টেগোর অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ব্যক্তির পদলাভ এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।

পুরো নাম ছিল তোমিকো ওয়াদা। স্বনামধম্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসক তাকেহিসা কোরাকে বিয়ে করেন ১৯২৯ সালে। তখন থেকে তিনি হন তোমি কোরা। সেই বছরেই রবীন্দ্রনাথ জাপানে যান দুবার আমেরিকা-কানাডা যাওয়া এবং ফেরার পথে। তোমি কোরা উদ্যোগ নিয়ে আসাহিশিম্বুন পত্রিকার নিজস্ব সভাগৃহে ‘বাংলা কবিতা’র উপরে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলায় ও ইংরেজিতে কবিতা আবৃত্তি করেন আর মাদাম কোরা পাশে বসে কবিতার জাপানি অনুবাদ শোনান শ্রোতৃবৃন্দকে। ‘রবীন্দ্রজীবনীকার’ প্রভাতকুমার লিখেছেন--‘সন্ধ্যায় আসাহিদের হলঘরে কবি-সংবর্ধনা হয়। কবির ভাষণ দোভাষী জাপানিতে তর্জমা করিয়া দেন। সেই রাত্রে মোটরে করে য়োকোহামায় যান এবং পরদিন (২৮ মার্চ) “ভারতীয়দের নিমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজন সেরে বেলা তিনটের সময় কানাডায় পাড়ি।’”

রবীন্দ্রনাথ কানাডা যাওয়ার আগে ইংরেজিতে কবিতার আকারে তাঁর ইচ্ছা জানিয়ে লেখেন, ‘যাবার সময় আমার আকাক্সক্ষার কথা বলতে চাই, আর একবার জাপানে যেন আসতে সক্ষম হই। তারপর জাপানের বন্ধুত্বসিক্ত হাতে স্পর্শিত হয়ে জাপানের হৃদয়ের কোণে আমার আসন যেন দেখতে পাই।’ কানাডায় রবীন্দ্রনাথ দশ দিন থেকে গেলেন আমেরিকায়। লসএঞ্জেলসে পৌঁছালেন ১৮ই এপ্রিল। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বক্তৃতাও দিলেন। তারপরই ঘটল বিভ্রাট, হারিয়ে গেল তাঁর পাসপোর্ট। নানা রকম তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে ২০ই এপ্রিলেই আমেরিকা থেকে ফিরে চললেন জাপানে। ছোট্ট একটা টেলিগ্রাম পাঠালেন মাদাম কোরাকে। প্রবীর বিকাশ সেই টেলিগ্রামটির ইংরেজি বয়ন উদ্ধৃত না করে বাংলা অনুবাদ দিয়েছেন, ‘পর্যটক হিসেবে আমি মেশিনের শব্দে একেবারেই ক্লান্ত। সূর্যোদয়ের দেশ জাপান দেবতার দেশ--মানুষকে মূল্য দিয়ে থাকে। সেখানেই আমি যাবার ইচ্ছে পোষণ করছি।’ টেলিগ্রাম পেয়েই মাদাম কোরা যোগাযোগ করলেন রাসবিহারী বসুর সঙ্গে। তিনিই ১৯১২ সালে দিল্লিতে লর্ড হার্ডিঞ্জকে বোমা ছুঁড়েছিলেন এবং ১৯১৫ সালে নিজেকে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় বলে পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট জোগাড় করে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে জাপানে পালিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য জাপানে ফিরে আসছেন বুঝে রাসবিহারী তাঁর বন্ধু ড.ওওকুরা কুনিহিকোর শরণাপন্ন হলেন। কুনিহিকো ধনী ব্যবসায়ী হলেও রবীন্দ্রনাথের গুণগ্রাহী ছিলেন। টোকিওর মেগুরো শহরে অবস্থিত তাঁর প্রাসাদের মতো বাড়ি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাওয়া হল ওই বাসভবনে। আমেরিকায় পাঠ করার জন্য চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ খবরংঁৎব নামে দুটি পর্বে সম্পূর্ণ যে বক্তৃতামালা তৈরি করেছিলেন সেটি তিনি এখন জাপানে পাঠ করতে চাইলে মাদাম কোরার ব্যবস্থাতে আসাহিশিম্বুন পত্রিকার সভাগৃহে দুদিনে পাঠ করেন। এই বক্তৃতাটি পরে ‘ইউকান তেৎসুগাকু’ নামে তোমি কোরা জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ জাপানে পৌঁছান ১০ই মে আর ৮ই জুন দেশের পথে রওনা হন এক ফরাসি জাহাজে।

১৯৩১ সালে জাপান আক্রমণ করে চীনকে। মাদাম কোরার স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে তখন তিনি বিশেষভাবে বিচলিত হন এবং ভারত থেকে মহাত্মা গান্ধীকে ডেকে নিয়ে এসে একটি শান্তি সম্মেলন আয়োজন করার চেষ্টা করেন। কেন সেই চেষ্টা সফল হয়নি তা প্রবীর বিকাশ জানাননি। যাইহোক, ১৯৩৫ সালে নিখিল ভারত নারী সংস্থার আমন্ত্রণে ভারতে এসে মাদাম কোরা প্রথমেই যান শান্তিনিকেতনে। এবার তাঁর স্মৃতিকথা থেকে প্রবীর বিকাশ যেটুকু অনুবাদ করে দিয়েছেন সেটুকু উদ্ধৃত করি--‘ঠাকুর মহাশয় খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। জাপানে তিনি বিপুল আতিথ্য গ্রহণ করেছেন তাই আমার জন্য সবচেয়ে ভালো অতিথিকক্ষের ব্যবস্থা করলেন। এছাড়া তাঁর নাতনী নন্দিতাকে (নন্দিনী নয়) আমার সার্বক্ষণিক সেবাযত্নের জন্য নিযুক্ত করে দিলেন। এই নন্দিতা মেয়েটি ঠাকুর মহাশয় এখানে যখন ঠাকুর বিদ্যানিকেতন করেন সেই প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আছে--বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। আমার সঙ্গে হৃদয়ের মিল হয়েছিল, বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছি। দুঃখের বিষয় মেয়েটি বছর কয়েক আগে অসুখে ভুগে মৃত্যুবরণ করেছে। এই নন্দিতার পরিচালনায় আমি ঠাকুর মহাশয়ের বিদ্যানিকেতন ঘুরে ঘুরে দেখেছি, সপ্তাহখানেক শান্তিনিকেতনে ছিলাম।’

দেখা যাচ্ছে তোমিকো ওয়াদা রওফে মাদাম কোরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক সেই ১৯১৬ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল। এ এক মধুর সম্পর্কের দীর্ঘ কাহিনি। তাজ্জব ব্যাপার যে এদেশের রবীন্দ্রগবেষকগণ এই প্রায় বিশ বছর ধরে বিস্মৃত মধুর সম্পর্কের বৃত্তান্ত সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব! বরং কিছু কিছু ভুল তথ্য ‘রবীন্দ্রজীবনীকার’ প্রভাতকুমার দিয়েছেন বলে মনে হয়। ‘রবীন্দ্রজীবনী’র ৩য় খণ্ডে আছে যে পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ার দরুন আমেরিকাতে হয়রানির ফলে বিরক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ জাপানে ফিরে এসে ১৪ই মে থেকে ৮ই জুন পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় তিন সপ্তাহ ছিলেন। কোথায় ছিলেন? টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে। জাপানি জাতীয়তাবাদের ঘোর সমালোচক রবীন্দ্রনাথ তিন সপ্তাহ বিনা পাসপোর্টে জাপানের রাজকীয় হোটেলে সদলবলে থাকলেন এটা কি বিশ্বাস্য?

আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথ হয়রান হয়ে আমেরিকা থেকে জাপানে আসার পথে তোমি কোরাকে একটি টেলিগ্রাম করেন তাঁর আসার খবর দিয়ে, টেলিগ্রামটি পেয়ে তোমি কোরা যোগাযোগ করেন রাসবিহারী বসুর সঙ্গে, রাসবিহারী অনুরোধ করেন ব্যবসায়ী ও শিক্ষাবিদ ড.ওওকুরা কুনিহিকোকে (ওকাকুরা নন), তিনি ব্যবস্থা করেন টোকিওর মেগুরো শহরে অবস্থিত তাঁর প্রসাদোপম বাড়িতে। তোমি কোরা--রাসবিহারী বসু--ওওকুরা কুনিহিকো--এই তিনজন রবীন্দ্রনাথের এই তিন সপ্তাহ বসবাসের মূলে ছিলেন। আগ্রাসী জাতীয়তাবাদীদের রাজকীয় হোটেলে রবীন্দ্রনাথকে বিনা পাসপোর্টে তিন সপ্তাহ থাকতে দেওয়া অসম্ভব। প্রভাতকুমার তথ্য সংগ্রহ করেছেন ওখানকার বিশ্বভারতী বুলেটিন থেকে এবং তখন রাসবিহারী বসু চিহ্নিত ছিলেন ব্রিটিশের প্রধান শত্রুদের একজনরূপে। প্রভাতকুমার একথাও লিখেছেন যে ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ও রাসবিহারীর সাক্ষাৎ হয়েছিল। বিশ্বভারতী বুলেটিনে একথা প্রকাশ করা অসম্ভব ছিল যে আমেরিকায় হয়রানির পরে রবীন্দ্রনাথ জাপানে বিনা পাসপোর্টে ব্রিটিশের পরম শত্রু রাসবিহারী বসুর সৌজন্যে ওওকুরা কুনিহিকোর ভবনে বাস করেছিলেন।

যখন ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবর্ষর আয়োজন শুরু হয় জওহরলাল নেহ্রু ওই শতবর্ষ যাতে সারা বিশ্ব জুড়ে উদযাপিত হয় তার তোড়জোড় শুরু করেন কয়েক বছর আগেই। তাঁর নির্দেশে রবীন্দ্রভবনের তৎকালীন অধ্যক্ষ ক্ষিতীশ রায় জাপানে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ জানান ড.ওওকুরা কুনিহিকোকে। অতঃপর কুনিহিকোর উদ্যোগে গঠিত হয় টেগোর মেমোরিয়াল আ্যাসোসিয়েশন-জাপান। নিজে হন এর চেয়ারম্যান। পরিচালকবৃন্দ হন অধ্যাপক কিজোও ইনাজু, মিচিও হারাদা, তেনশিনের পৌত্র কোশিরোও ওকাকুরাসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি। অনুষ্ঠানের বিচিত্র ও বিশাল আয়োজন করা হয়। দু বছর ধরে বিভিন্ন শহরে ২০টি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া কর্মসূচির প্রধান দুটি অঙ্গ ছিল, অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ‘সত্য’ নামে একটি মাসিক বুলেটিন প্রকাশ, যাতে থাকত রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রবীন্দ্রসাহিত্যের অনুবাদ এবং কোথায় কবে কী অনুষ্ঠান হচ্ছে বা হবে তার খবরাখবর। এই বুলেটিনের মোট ২২টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ‘সত্য’ ছাড়া অ্যাপোলন শা নামক প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয় আট খন্ডে রবীন্দ্রসাহিত্যের জাপানি অনুবাদ। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের ‘জাপানযাত্রী’ গ্রন্থটি অনুবাদ করেন যৌথভাবে অধ্যাপক কিজোও ইনাজু ও সন্দ্বীপ ঠাকুর। জাপানের সেই অর্থসংকটের দিনে অ্যাসোসিয়েশন মোট ৬,৫৫০,৫০০ ইয়েন খরচ করে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে জাপানের উপরে শুধু মার্কিন অর্থনীতি ও রাজনীতি সিন্ধাবাদের ঘাড়ে বুড়োর মতো চেপে বসেনি, মার্কিন সংস্কৃতিও চেপে বসে। মার্কিনি বাতাসে জাপানের নিজস্ব সাংস্কৃতিক সৌধের নানা অংশ ভেঙে পড়ে। এই পর্বে জাপানে রবীন্দ্রচর্চাকে যিনি উজ্জীবিত করেন তিনি বিশ্বভারতীর জাপানি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক কাজুও আজুমা। তিনি ১৯৭২ সালে জাপান-টেগোর সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সূত্রে বহু জাপানি তরুণ-তরুণী, অধ্যাপক ও গবেষক বিগত ৩০ বছরে শান্তিনিকেতনে এসেছেন এবং তাঁরই উদ্যোগে ১৯৯৪ সালে শান্তিনিকেতনে ‘নিপ্পন ভবন’ এবং ২০০৭ সালে কলকাতার সল্টলেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন’। ২০১১ সালের ২৮ শে জুলাই রবীন্দ্রচর্চার এই পুরোহিত ৮০ বছর বয়সে জাপানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। প্রবীর বিকাশ সরকার ২০০৯ সালেই ‘জানা অজানা জাপান’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘অধ্যাপক কাজুও আজুমা আজ বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্রচর্চায় এক কিংবদন্তী নাম।’