শরীয়তপুর প্রতিনিধি : চেয়ারম্যান ইউনুস সরকার তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট সমতুল্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে সামান্য কোন অপরাধেই এলাকার লোকদের জুতো পেটা করানোয় সিদ্ধ হস্ত বলে পরিচিতি কুড়িয়েছেন ইতিমধ্যে। সম্প্রতি বিয়ে বাড়িতে সংঘর্ষের ঘটনায় ২৪ যুবককে একসাথে জুতো পেটা করার ঘটনায় তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন এলাকার সুমীল সমাজের লোকেরা।

ঘটনার বিবরণ ও স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস সরকারের নির্দেশে তুচ্ছ ঘটনায় ২৪ যুবককে জুতাপেটা ও অর্থদন্ড করার অভিযোগ উঠেছে। গত ৭ জানুয়ারী শনিবার উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে শত শত মানুষের উপস্থিতিতে এ জুতোপেটা ও অর্থদন্ড করা হয়। দন্ডিপ্রাপ্ত যুবকরা এলাকার এক বিয়ে বাড়িতে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা সহ মারপিট করে অতিথিদের আহত করার দায়ে অভিযুক্ত ছিল। মেয়ের গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নাচ গানের আয়োজন করার অপরাধে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে কনের পিতাকে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ৩০ ডিসেম্বর ভেদরগঞ্জের উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়নের রসুল মালের বড় মেয়ে সাবিনা আক্তারের বিয়ের দিন ধার্য ছিল। এ উপলক্ষ্যে ২৯ ডিসেম্বর রাতে ছিল সাবিনার গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে আনন্দ উৎসব করতে পাশবর্তী জেলা চাঁদপুরের সঙ্গীত ও নৃত্য শিল্পীদের দিয়ে নাচ-গানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন স্থানীয় যুবক শ্রেণী সহ বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ। সেখানে কনের মামা রাসেলের সাথে স্থানীয় শফি মাঝির ছেলের কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। স্থানীয় মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি তাৎক্ষনিকভাবে সমাধান হয়।

৩০ ডিসেম্বর শুক্রবার বর পক্ষ কণে সাবিনাকে নিয়ে যাওয়ার পরেই শফি মাঝির ছেলে ও তার সহযোগীরা বিয়ে বাড়িতে হামলা চালায়। এতে কণের মামা মনির, আজিজুর রহমান, এরশাদ ও ফয়সাল আহত হয়। বিষয়টি মীমাংসার জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুস সরকার ৭ জানুয়ারী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে শালিসীর আয়োজন করেন। শালিসীর রায়ে চেয়ারম্যান দন্ডপ্রাপ্ত ২৪ জনের প্রত্যেক যুবককে ২ হাজার ৫ শতর টাকা করে ৬০ হাজার টাকা জরিমান ও প্রত্যেককে ১০টি করে জুতোপেটার আদেশ প্রদান করেন। তখন ইউনিয়ন পরিষদের সম্মেলন কক্ষে চেয়ারম্যানের নির্দেশে অভিযুক্ত যুবকদের অভিভাবকরা নিজ নিজ সন্তানদের জুতাপেটা করেন। সেখান থেকে কণের পিতা রসুল মালের বাড়িতে নাচ-গানের আয়োজন করার অপরাধে তাকেও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

চেয়ারম্যানের রায়ে জুতোপেটার দন্ডিত অসহায় যুবকেরা হলেন, শফি মাঝির ছেলে সোহাগ, ছোবাহান আসামীর ছেলে মঙ্গল আলী, দিদার সরকারের ছেলে আক্তার ও মেছউদ্দিন, নিজাম আসামীর ছেলে পারভেজ, নোমান সরকারের ছেলে রাজ্জাক, রশিদ সরকারের ছেলে সুজন, ইউছুব সরকারের ছেলে শাকিল, হজরত আলীর ছেলে ইব্রাহীম, মাইনদ্দিন প্রধানিয়ার ছেলে আব্দুস সালাম, মনা মোল্লার ছেলে রিয়াজ, মগবুল মাঝির ছেলে ফয়সাল, রমিজ প্রধানিয়ার ছেলে কানাই, সেকুল মোল্যার ছেলে সাইফুল, শুকুর আলী মোল্যার ছেলে জাহিদ, সিরাজ বেপারীর ছেলে সবুজ, জালাল উদ্দিন সরকারের ছেলে মুন্সী, ছামাদ মোল্যার ছেলে আলী আজগর, রশিদ মাদবরের ছেলে নুরে আলম, রফিক সরদারের ছেলে জামাল, হজরত আলী বেপারীর ছেলে মজিবর, খোকন সরকারের ছেলে সাকিল, রশিদ প্রধানিয়ার ছেলে মনির, সামাদ মোল্যার ছেলে নিজামসহ সাকিল ও সোহেল।

কণের পিতা রাসুল মাল বলেন, আমার বড় মেয়ে সাবিনার বিয়ের গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গান বাজনার আয়োজন করি। সেখানে স্থানীয় শফি মাঝির ছেলে তার বখাটে বন্ধু ও ভাড়াটে লোকদের নিয়ে পরিবেশ নষ্ট করে। আমার শ্যালক রাসেল প্রতিবাদ করায় তার সাথে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। স্থানীয় ভাবে বিষয়টি মীমাংসা হওয়ার পরেও শফি মাঝির ছেলে তার লোকজন নিয়ে এসে আমার বাড়িতে হামলা চালায়। এতে আমার ৪ শ্যালক গুরুতর আহত হয়। ঘটনার ৭ দিন পর স্থানীয় চেয়ারম্যান ইউনুস সরকার পরিষদে বিচার বসায়। সেখানে বখাটেদের প্রত্যেককে জরিমানা ও জুতাপেটার হুকুম দেন। বাড়িতে গান-বাজনা আয়োজন করার অপরাধে আমাকেও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন চেয়ারম্যান ইউনুস সরকার।

চেয়ারম্যানের নির্দেশে দন্ডিত পারভেজের পিতা নিজাম আসামী বলেন, জুতাপেটা আইনে নিষিদ্ধ। তার পরেও চেয়ারম্যান আমাদের জনপ্রতিনিধি হয়ে এ নিষিদ্ধ জঘন্য কাজ করেছেন। আমার ছেলে এ ঘটনার সাথে জড়িত ছিল না। তার পরেও উদ্দেশ্যমূলক ভাবে আমার ছেলেকে জুতাপেটা করা হয়েছে। এর পূর্বেও চেয়ারম্যান একটি ঘটনা কেন্দ্র করে নগদ টাকা জরিমান ও জুতাপেটার হুকুম দিয়েছিল। আমি এ ঘটনার বিচার দাবী করছি।

একাধিক এলাকাবাসী জানান, এই চেয়ারম্যান প্রতিটা বিষয়ে খুব বাড়াবাড়ি করে। পান থেকে চুন খসলেই জরিমানা ও জুতাপেটা করে। একজন পিতার হাতে পূত্রকে জুতো পটো করানোটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। যারা চেয়ারম্যানের হুকুমে জুতাপেটার শিকাড় হয়েছে তারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে। ফলে মানসিকভাবেও খুব ভেঙ্গে পরেছে। আমরা এই জুলুম থেকে পরিত্রান চাই।

উত্তর তারাবুনিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুছ সরকার বলেন, আমি নৌকা প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান হয়েছি। জেলা জজ, লিগ্যাল এইড ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছে আমি তৃতীয় শ্রেণী ম্যাজিস্ট্রেট সমকক্ষ বিচারিক ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি। আমি ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবো। তবে আমি ২৪ জন বখাটেকে ৬০ টাকা জমিরানা করেছি। এলাকা নিয়ন্ত্রনে রাখতে অনেক কিছুই করতে হয়। তাছাড়া আমি কাউকে জুতাপেটা করিনি। অভিভাবকরাই নিজ নিজ সন্তানদের জুতা পেটা করেছে। অভিযুক্ত যুবকরা বিয়ে বাড়িতে মারপিট করে ৫ জনকে আহত করেছে আর খাবার নষ্ট করেছে। আহতদের চিকিৎসায় টাকা লাগছে। বিয়ে বাড়িতে নাচ-গানের আয়োজন করায় এ ঘটনা ঘটেছে তাই কণের পিতাকে বলেছি ৫০ হাজার টাকা এতিম খানায় দেওয়ার জন্য।

ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহেল আহমেদ বলেন, এমন একটা ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুটা জানতে পেরেছি। কোন অপরাধিকেই জুতোপেটা করানোর এখতিয়ার চেয়ারম্যান বা কোন জনপ্রতিনিধিকে দেয়া হয়নি। আইনের সুনিদিষ্ট নিয়ম মতে ইউপি চেয়ারম্যানরা কাউকে জরিমানা করার ক্ষমতা রাখেন।কিন্ত আইন বহির্ভূতভাবে জুতোপোট বা এই ধরনের কোন বিচারে কাউকে দন্ডিত করলে তা যদি কেউ অভিযোগ করনে এবং তা প্রমানিত হয়, তাহলে অবশ্যই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

(কেএনআই/এএস/জানুয়ারি ১৪, ২০১৭)