কাজী আনিছ : গর্ব করার মতো আমার জীবনে একটাই বিষয় আছে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। সামগ্রিকভাবে এ কথা সত্য।

কিন্তু আমি এখনও বিশ্বাস করি এবং বাস্তবিকভাবেই আমি দেখেছি, আমার যতটুকু না যোগ্যতা তার চেয়ে শতগুণ যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন আমার মতো কয়েকজন, যারা কি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি বা পড়তে পারেনি। নাম উল্লেখ করলে অহরহ করা যায়।

সাংবাদিকতা জীবনে আমি এমন অনেক সহযোদ্ধার কছে থেকে শিখেছি, বলতে গেলে এখনও তাদের প্রতিবেদন পড়ে শিখি-জানার চেষ্টা করি যারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

আমার এ উপলদ্ধি থেকে মাঝে মাঝে মনে হয়, শিক্ষা আর নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের বৈষম্য করে যাই।

শিক্ষকতার চাকরিতে আমি এটা দেখছি অহরহ। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, দেশের বাইরে গিয়ে এক উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্সও করেছে, বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করা সত্ত্বেও তার শিক্ষকতার চাকরি হচ্ছে না। যতদূর তাঁকে দেখেছি, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিদ্যায় তাঁর অনেক ভাল দক্ষতা আছে, পড়ানোর মতো যোগ্যতাও আছে।

আমি এমন অনেক অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের চিনি, যারা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ জীবনে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছে, কী শিক্ষায়, কী নেতৃত্ব গুণে! কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁদের সেই দক্ষতা দেখানোর ক্ষেত্র পাওয়াতে কতটুকু কাঠখর পোহাতে হয়, শুধু অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ হওয়ার কারণে, তার কয়েকটির সাক্ষী আমি।

অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবার শীর্ষে। এটাও সত্য, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতেই নিয়োগ পায়। তারা কর্মক্ষেত্রে সেই দক্ষতার সাক্ষরও রাখেন। কিন্তু অন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রতি যেন কোনো বৈষম্য না করা হয়-সেই বিষয়টিও আমাদের নজরে রাখা দরকার। শুধু প্রথম দর্শনেই প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিভাজন যোগ্যতা আর দক্ষতা থেকে বিমুখ করে তোলে, কখনও সচেতনভাবে, কখনও অবচেতনভাবেই। মাপকাঠি হওয়া চাই যোগ্যতার, দক্ষতার-শুধু প্রতিষ্ঠান নয়। এ কাঠামো তৈরি করা না গেলে ভুক্তভোগী শুধু প্রতিষ্ঠানই হবে না, হবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিসহ পুরো সমাজ, রাষ্ট্র।

নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখতে পাই। ছাত্র সংগঠনগুলোর সর্বোচ্চ পদ তথা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আমরা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেখি না। আমার সঙ্গে কয়েকজন ছাত্র রাজনীতিবিদদের পরিচয় আছে। আমি অবাক হয়ে যাই, তাঁদের নেতৃত্বগুণ দেখে, তাঁদের ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা দেখে। এমনও অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা একটি সংগঠনকে নেতৃত্ব গুণে উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারে। অথচ তার কাছে সর্বোচ্চ পদটা আশা করা কিছুটা দুরূহ। মানসিকভাবে আমরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে তার জন্য এমন একটি 'অনুভূতি কাঠামো' তৈরি করেছি যে, জাতি তার কাছ থেকে অনেক কিছুই পেতে পারত, কিন্তু ওই কাঠামোই তা অাটকে দিচ্ছে।

সবকিছুতে ঢাকা কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ায়, কী কী সমস্যা আমাদের পোহাতে হচ্ছে তা আমরা জানি। ঢাকা শহরে যারা আছেন, তারা এ বেহাল দশার কথা জানেন। কেন্দ্র থেকে বেরোনোরও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞজনেরা।

শিক্ষা ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও আমরা যেন সবকিছু কেন্দ্রীভূত না করে ফেলি। বিকেন্দ্রীকরণ পুরো দেশেরই উন্নয়ন ঘটায়, সব প্রতিষ্ঠানেরও। না হলে ‌'কেন্দ্রীভূত' হওয়ার কুফল হয়তো আমাদের ভোগ করা লাগতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার অহংকার, আমার গৌরব। কিন্তু সবচেয়ে বড় আমার দেশ। দেশটাকে নিয়ে সবাইকে নিয়েই গর্ব করতে চাই।

লেখক: সিনিয়র লেকচারার, জার্নালিজম কমিউনিকেশন এন্ড মিডিয়া স্টাডিস বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ


(এসএস/অ/জানুয়ারি ২৮, ২০১৭)