ম. শাফিউল আল ইমরান


পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানাভাবে নারীকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে নারী অধিকার রক্ষায় জাতীয় ও অান্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। বিশেষ করে বাংলাদেশে। এখানে প্রতিটি পেশায় ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে ঠকানো হচ্ছে নারীদেরকে।

নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। কবির এ কথা শুধু কবিতাতেই নয়; দেশের অগ্রযাত্রায় আজ বাস্তব। কিন্তু অর্ধেক শ্রমের অংশীদার হলেও নারীরা পচ্ছেন না তাদের শ্রমের যথাযথ দাম। মজুরী পান পুরুষের অর্ধেক। নেই তাদের কাজের যথাযথ স্বীকৃতিও।

সম্প্রতি বিভিন্ন এলাকায় আলু চাষে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন পুরুষ শ্রমিক যেখানে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ টাকা মজুরি পায়; সেখানে একজন নারী শ্রমিক পাচ্ছে সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ১০০ টাকা। একই কাজ করে পুরুষরা তাদের চেয়ে দ্বিগুণ মজুরি পাচ্ছে।

নারীদের কম মজুরী দেওয়ার অজুহাতটাও অমানবিক। এসব নারী শ্রমিক কেউ বিধবা, কেউবা স্বামী পরিত্যক্ত আবার কেউবা অধিক সন্তানের ভারে অসহায়। অভাবে তাড়নায় একরকম বাধ্য হয়েই অত্যন্ত কম দামে তাদের শ্রম বিক্রি করে চলছে। অার এ নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজেরও কোনো মাথা ব্যথা নেই, নেই কোনো দায়ও। এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বরং বলতে চায়; আরও কম দামে নারীশ্রম পেলেও আপত্তি কোথায়।

এদেরই একজন রংপুরের পীরগঞ্জের হালিমা খাতুন। তার সাথে কথা বলে জানা গেল, গরীব ঘরে জন্ম, ছোট বেলা থেকেই মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে বড় হয়েছে। তখন থেকেই দেখে আসছি এমন; এটাকে নিয়ম বলেই মেনে নিয়েছি। আর আজ হঠাৎ করে বেশি দাম চাইলে কেউ কাজই দিবে না।

কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজ সেরে তারা পৌঁছে যায় তাদের কর্মস্থলে। খাওয়ার সময় নেই, নেই বিশ্রাম। বেঁচে থাকার তাগিদে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে নিরন্তর। নারী শ্রমিকের অধিকাংশই কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি তাদের কেউ কেউ চাতাল মিলে ধান শুকানো, ভাপানো কিংবা চাল তৈরির কাজ করে থাকেন। আবার কেউ মাটি কাটে, ইট ভাঙে। এত পরিশ্রমের পরেও নারীরা কর্মক্ষেত্রে মজুরী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

কৃষকরা বলছে, কৃষিতে নারী শ্রমিকরা পুরুষেরমত সব কাজ করতে পারে না বিধায় তাদের শ্রমের দাম কিছুটা কম।

নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর দাবি, দীর্ঘ দিন ধরে নারীকে ‘কৃষক’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হলেও প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করে নাই। একই সঙ্গে নারীর কৃষক হিসাবে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করার বিষয়টিও আছে। এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করার বিষয়টিও আছে।

বিভিন্ন তথ্য মতে, ফসল উৎপাদনে নারীর সক্রিয় অবদান ২৭ ভাগ। অথচ কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরে পুরুষ কৃষকের জন্য সুনির্দিষ্ট ‘ডাটাবেজ’ তৈরি থাকলেও নারী কৃষকের সেটা নেই। প্রতিদিন সূর্য উদয় থেকে শুরু করে সূর্য অস্তের আগ পর্যন্ত কাজ করে মাত্র ১ ঘণ্টা সময় পাচ্ছে দুপুরের খাবারের জন্য। এসব অধিকাংশ নারী শ্রমিকের কাজের জন্য কোনো সুষ্ঠ পরিবেশও নেই। রোদ ও বৃষ্টিতে বসার মতো কোনো জায়গাও নেই তাদের।

কৃষিকাজ ও অন্যান্য কাজে নিয়োজিত নারীদের দাবি, নারীকে শ্রম আইনে অর্ন্তভূক্ত করে কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। গ্রামীণ জীবনযাত্রায় স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচার অভিযান এর ২০১২ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের মোট নারী শ্রম শক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৬২ লাখ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী। যার ৬৮ শতাংশ কৃষি, পোলটি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত।

বিশ্ব ব্যাংকের ২০০৮ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কৃষি খাতে নিয়োজিত পুরুষ চেয়ে নারীর অবদান শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি। এছাড়া কর্মক্ষম নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত আছে কৃষিকাজে। বাংলাদেশ উন্নযন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) এক গবেষণা বলছে, গ্রামীণ ৪১শতাংশ নারী আলু চাষের সঙ্গে জড়িত।

কৃষি কাজে নারীর অবদান থাকা সত্বেও তাদের কৃষক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। এতে এক জন পুরুষ যেসব সুবিধা ভোগ করছে কৃষাণীরা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের রংপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক রুমানা জামান বলেন, স্থানীয়ভাবে যারা এই (কৃষি) পেশায় আছে সেই সব নারীদের সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি কৃষকদেরও সচেতন করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক।