একুশের গল্প

আনিকা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। ভাষা আন্দোলনের কথা সে বইয়ে পড়েছে। সে জানে এই দিনটি শুধু শহীদ দিবস নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সারা বিশ্বে পালন করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন। এই দিন খুব সকালে সব বয়সের লোকেরা শহীদমিনারে যায় ফুল দিতে। খুব ছোটবেলায় সে তার বাবার সাথে একবার শহীদমিনারে গিয়েছিল ফুল দিতে। তাছাড়া প্রতিবছর সে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে টেলিভিশনে নানা অনুষ্ঠান দেখে থাকে। শহীদমিনারে ফুল দেওয়ার দৃশ্যও সে খুব মজা করে দেখে। তার বাবা এবার আনিকাকে শহীদমিনারে নিয়ে যাবেন ফুল দিতে। তাই সে মনে মনে ভীষণ খুশি। সে অপেক্ষা করছে, কবে সেই শহীদদিবস আসবে তার জন্য।

একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে আনিকার বাবা বেশকিছু ফুল কিনে এনেছেন। তার মা সেই ফুল দিয়ে একটি মালা তৈরি করেছেন। আগামীকাল খুব সকালে তারা এই মালাটি নিয়ে শহীদমিনারে যাবে। আনিকা তার বাবা-মায়ের সঙ্গে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। বাবার সঙ্গে সে ফুলের মালা নিয়ে যাচ্ছে শহীদমিনারে। আনিকাদের মতো অনেকেই ফুল এবং ফুলের মালা হাতে নিয়ে শহীদমিনারে যাচ্ছে। শহীদমিনারে ফুল দিতে পেরে আনিকা ভীষণ খুশি।

একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আনিকার অনেক কিছু জানার কৌতূহল। সে তার বাবার কাছে এ বিষয়ে অনেক কিছু জানতে চায়। সে জানতে চায় ভাষা আন্দোলন কেন হয়েছিল, কীভাবে আন্দোলন হয়েছিল, আন্দোলনে কতজন শহিদ হয়েছিল, তাদের পরিচয় কী ছিল ইত্যাদি। তার বাবা একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন।

আনিকার বাবা তাকে বললেন, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা ছিল তাদের বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী। নানান অপকৌশলে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করত। তারা এই শোষণের কাজকে দীর্ঘ করার জন্য বেশকিছু পথ বেছে নেয়। তার মধ্যে একটি হলো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা। অথচ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা আর মাত্র ৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন হয় সেটাই ছিল ভাষা আন্দোলন। একুশের চেতনাই বাঙালি জাতিকে দিয়েছে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের প্রেরণা।

ভাষাবাংলা আমাদের মুখের ভাষা, আমাদের প্রাণের ভাষা। এই ভাষাকে রক্ষা করার জন্য সেই সময় ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, সাধারণ মানুষসহ পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনে অনেকেই শহীদ হয়েছেন। তাদের অনেকের লাশ গুম করে ফেলার কারণে খুঁজে পাওয়া যায়নি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে মাত্র ৫-৬ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তারা হলেন আবদুস সালাম, রফিক উদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান।

শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ বাবার সঙ্গে প্রেস পরিচালনায় যোগ দেন। তার গ্রামের বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার পারিল (বতর্মানে যার নামকরণ হয়েছে রফিকনগর) গ্রামে। শহীদ আবুল বরকত ভারতীয় উপমহাদেশের (অবিভক্ত) মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। ক্যানসারে আক্রান্ত শাশুড়িকে চিকিৎসা করানোর জন্য ময়মনসিংহ হতে ঢাকাতে আসেন শহিদ আবদুল জব্বার। গ্রামে তিনি দৈনন্দিন জিনিসপত্রের ছোটখাটো একটি দোকান দিয়ে ব্যবসা করতেন। শহীদ শফিউর রহমান ঢাকায় হাইকোর্টে করনিক পদে চাকরি করতেন। তার বাড়ি ছিল অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের হুগলি জেলার কোন্নগর গ্রামে। শহিদ আবদুস সালাম ৮৫ দিলকুশাস্থ ‘ডাইরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ’-এ করনিক পদে চাকরি করতেন। তার বাড়ি ছিল ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া উপজেলার লক্ষ্মণপুর গ্রামে। একুশে ফেব্রুয়ারির বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছে গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তীতে তিনি ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের তালিকায় রয়েছে একজন নয় বছরের বালক, যার নাম অহিউল্লাহ এবং আবদুল আউয়াল নামে একজন রিকশাচালক। ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রোডে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশ গুলিতে তারা নিহত হন।

আনিকার বাবা আরো বললেন, সারা বিশ্বের মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এখন চেষ্টা করা হচ্ছে। মাতৃভাষার গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আমাদের উচিত মাতৃভাষাকে সম্মান করা। মাতৃভাষাকে কখনো অবহেলা করা উচিত নয়। আমাদের এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যাতে বাংলাভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা সবসময় চেষ্টা করব সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহার করতে।
ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আনিকা বাবার মুখ থেকে অনেক কিছু শুনেছে। এসব কথা শুনে ভাষাশহীদদের প্রতি তার মন শ্রদ্ধায় ভরে যায়। আনিকা তার বাবাকে অজান্তেই প্রশ্ন করে বসল। বাবা, তুমি কেন আমাকে ইংরাজি ভাষা ভালোভাবে শেখার জন্য বকাবকি কর? আমি তো এখনো বাংলাভাষা ভালোভাবে শিখতে পারিনি। আর তুমি তো কথা বলার সময় শুধু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার কর। আনিকার বাবা এ রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন তা সে ভাবতেও পারেননি। মেয়ের এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাবা চুপ থাকলেন।