এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক


গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় গণমাধ্যমকে। দেশের প্রতিটি সরকারই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা বিধানের কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতা অনেক নির্মম। প্রায় প্রতিদিনই কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। প্রতিটি সরকারের সময়ে, সব ধরনের পরিস্থিতিতে। কখনো শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন, কখনো শিকার হচ্ছেন হয়রানির। কখনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে, কখনো রাষ্ট্রের হাতে। স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নেমে আসে খড়গ। হামলা, মামলা, আর হয়রানিতে দুর্বিষহ করে তোলা হয় জীবন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র হালিমুল হক মিরু হামলাকারীদের লক্ষ্য করে তার শটগান থেকে গুলি ছোড়েন। এ সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক শিমুল। পরে তাকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় হয়। শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে সেখান থেকে ঢাকায় আনার পথে তিনি মারা যান।

এদিকে ২৬ জানুয়ারি শাহবাগে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা অর্ধদিবস হরতাল চলাকালে পুলিশ এটিএন নিউজের স্টাফ রিপোর্টার ইহসান বিন দিদার ও ক্যামেরাপারসন আব্দুল আলিমের হামলা উপর হামলা চালায়। তার রেশ না কাটতেই শুক্রবার বিকেল ৬টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’র ফটো সাংবাদিক জীবন আহাম্মেদকে মারধর করে পুলিশের কিছু বেপরোয়া সদস্য।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জীবন আহাম্মেদ বলেন, ‘আমি বইমেলার নিউজের ছবি তুলতে এসেছিলাম। টিএসসির রাস্তার পাশে বাইক পার্ক করতে যাওয়ায় এক পুলিশ এসে ধাক্কা দেয়। আমি তাকে বললাম, ভাই ধাক্কা দিচ্ছেন কেন? মুখে বললেই তো সরে যাই। এ কথা বলতেই পেছন থেকে এক আরেক পুলিশ এসে আমাকে মারতে শুরু করে। তারপর ৬/৭ জন এক সঙ্গে।’ শুধু মারধরই নয়, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে পুলিশের ওই সদস্যরা। তাদের মধ্যে একজন উচ্চস্বরে বলতে থাকেন ‘আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ, একবারে মামলা দিয়া ভিতরে ঢুকাইয়া দিমু।’ বলেও জানান এই ফটো সাংবাদিক।

গণমাধ্যমের এ আক্রান্ত অবস্থায় দেশের গণতন্ত্র যে রুগ্নতম সময় পার করছে তা অনুমেয়। কেননা, গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র অবস্থানের দিক থেকে একই সুতোয় গাঁথা। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করলেও পুলিশি নির্যাতনেরও শিকার হতে হয় সংবাদকর্মীদের। যদিও উভয়ই ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে। কিন্তু রাজপথে, বিপজ্জনক মুহূর্তে মাঝেমধ্যে পুলিশই হয়ে পড়ে সাংবাদিকের প্রতিপক্ষ। পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতির ঝাল মেটান সাংবাদিকদের ওপর। পরে ‘গরু মেরে জুতা দান’-এর মতো মৌখিক দুঃখ প্রকাশও করেন। তবে এটুকুতেই প্রতিকারের সমাপ্তি।

একইভাবে রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকের সম্পর্ককে আখ্যায়িত করা হয়- জল ও মাছের সম্পর্কে। কিন্তু যতই বস্তুনিষ্ঠ হোক, নিজের বা নিজ গ্রুপের বিপক্ষে গেলেই প্রতিপক্ষ হয়ে পড়েন রাজনীতিবিদরাও। তারাও হুমকি-ধমকি দেন, কর্মক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে সাংবাদিকদের ‘উপহার’ দেন বেকারত্ব। নিজস্ব সুবিধাবাদীদের দিয়ে মামলায় জড়িয়ে দেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। আমলারা করেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানা হয়রানি। কিন্তু সাংবাদিকতার নৈতিকতায় সাংবাদিকরা কারো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু হতে পারে না। অনিয়মের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড়াতেই হয়। ফলে সাংবাদিকরা হয়ে পড়েন অপছন্দের পাত্র। তাদের গলা টিপে ধরতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন সবাই। অথচ অপছন্দের কথাগুলো তুলে ধরতে হয় দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের সময়েই সাংবাদিকদের ওপর নেমে এসেছে নির্যাতনের খড়গ। বেকারত্বের পাশাপাশি নিগৃহীত হন বহু সাংবাদিক।

জিয়া সরকারের সময়ে সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি পেলেও নির্যাতন থেকে রেহাই মেলেনি সাংবাদিকদের। এরশাদ সরকারের সময়ে দেশ ছেড়েছেন অনেক সাংবাদিক, বন্ধ হয়েছে সংবাদপত্র। জিয়া ও এরশাদ সরকারের মার্শাল ল’ কোর্টে হয়রানির শিকার হয়েছেন বর্তমান বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের অনেকেই। নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বড় ভূমিকা ছিল গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের। স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রতিটি সরকারের সময়কাল রঞ্জিত হয়েছে সাংবাদিকের রক্তে। অথচ শিল্প হিসেবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ও সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রতিটি সরকারই থাকেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কোনো সরকারের হাতেই প্রণীত হয়নি একটি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন। এমনকি দেশে একের পর এক সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটলেও কোনো খুনের বিচার প্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে এগোয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটিরও। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দিনের পর দিন সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে সাংবাদিকতা পেশা ক্রমাগতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথাগত দুঃখ প্রকাশ ও হামলাকারীদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সাংবাদিকদের পেশায় এ চলমান ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্র কি কোনো উদ্যোগ নেবে? দূর ভবিষ্যতে কি কোনো উজ্জ্বল আলো অপেক্ষা করছে?

ইতোপূর্বে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন যশোরের শামছুর রহমান কেবল, সাইফুল আলম মুকুল, হুমায়ুন কবির বালু, বেলাল হোসেন প্রমুখ প্রথিতযশা সাংবাদিক। সম্প্রতি কুষ্টিয়া, রংপুর, বরিশাল, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রায়ই সাংবাদিকদের দমন-পীড়ণের স্বীকার হতে হচ্ছে । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আজও আমাদের রাজপথে দাঁড়িয়ে এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডের ও নির্যাতনের বিচার দাবি করতে হচ্ছে। অথচ এসব হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের বিচার না হলে সাহসী সাংবাদিক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষসহ অসাম্প্রদায়ীক চেতনাধারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে না আইনের শাসন, ন্যায় বিচার ও মানবাধিকার। তাই সরকার, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন রাখছি, সুষ্ঠু বিচার, প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থা গ্রহণের।

নতুনদের বলি, ‘কে আছো জওয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ...!’ বিপন্ন সৎ সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিতে হবে কঠিন হাতে। একশ’ বছর আগে কাঙাল হরিনাথ বলেছিলেন, ‘সৎ সাংবাদিকের কোন বন্ধু থাকতে নেই।’ আজ একশ’ বছর পর সাংবাদিক বন্ধুদের বলি, নিজেদের মধ্যে আর বিচ্ছিন্নতা নয়। প্রতিহিংসা নয়। একে অপরের সহযোগী এবং সহায়ক শক্তি যেন হয়ে উঠতে পারি। পেশাদারী মনোভাব নিয়ে সুস্থ প্রতিযোগিতায় সমৃদ্ধ করতে হবে সাংবাদিকতাকে।

আবারো নজরুলের ভাষায় বলি, ‘বন্ধুগো, বলিতে পারি না, বড়ো বিষজ্বালা এই বুকে। দেখিয়া-শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি- তাই যাহা আসে কই মুখে।’ সত্যকে মেনে নেবার সৎসাহসে সকল শুভ শক্তিকে একসাথে এগিয়ে যেতে হবে অনেকদূর। বিনাশ করতে হবে সকল অশুভ শক্তি, অন্যায় আর হিংসা। বন্দি বিবেককে এবার মুক্ত করে দেওয়া হোক। জয় হোক সত্যের। জয় হোক সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার।

লেখক : আইনজীবী ও গবেষক।