শফিকুল ইসলাম খোকন


ব্যক্তি থেকে শুরু করে দেশের সকল ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ছোয়া লেগেছে সেটি যেমন অস্বীকার করার সুযোগ নেই, তেমনি এত আধুনিকতার ছোয়া থাকলেও সরকারি অনলাইন ব্যাংকিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরে প্রযুক্তির ছোয়া যে নেই সেটিও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু সরকারি দপ্তরগুলো পিছিয়ে কেন? কেনই বা অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টরে বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে এতটা পিছিয়ে সরকারি ব্যংকগুলো। এর উত্তরই বা কে দিবে? এর রহস্য আসলে কি?

সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে অনলাইন ব্যাংকিং এর দিক থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা। অনলাইন ব্যাংকিং লাভজনক হলেও পিছিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো। এগিয়ে রয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। যার ব্যবধান আকাশ-পাতাল। বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তিতে এতো এগিয়ে থাকা সত্বেও অনেকাংশে পিছিয়ে। সেটি সরকারি দপ্তরগুলোতে চোখে পড়ার মত। যেমন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক একটি ঐতিহ্য ও পুরাতন ব্যাংক। এ ব্যাংকের অগণিত গ্রাহক রয়েছে গ্রামগঞ্জে এবং শহরে। কিন্তু এ ব্যাংকটিও অনলাইন ভিত্তিক সেবা না থাকায় সেরকারি ব্যাংকের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে। তথ্যপ্রযুত্তিতে দক্ষ কর্মীর পেছনে ১ টাকা ব্যয় করলে ব্যাংকের আয় বাড়ে ২৫ টাকা। এ ছাড়া অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ফলে ‘কস্ট অব ফান্ড’ ৬ টাকা থেকে কমে ২ টাকা হয়েছে। কিন্তু অনলাইন ব্যাংকিংয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা হতাশাজনক। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের ব্যাপক উন্নতি হলেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে সরকারি ব্যাংক। অনেক ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যাংকিংয়ে বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট হয়ে সরকারি ব্যাংককে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে এটি হতাশাজনক।

সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে ‘ব্যাংকের ব্যবসা ও মুনাফা বৃদ্ধিতে আইসিটির প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়, ‘প্রথাগত ব্যাংকিং মাধ্যমে এখন বছরে গড়ে ১৭০ কোটি বার লেনদেন হচ্ছে। আর আইসিটির কারণে অনলাইনে ২০০ কোটি বারের বেশি লেনদেন হচ্ছে। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ব্যাংক খাতের একজন কর্মী এখন বছরে গড়ে ১০ হাজার লেনদেন সম্পন্ন করছেন। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত ব্যাংকের একজন কর্মীর গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৫ হাজারের কম। অর্থাৎ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গত দেড় দশকে ব্যাংকের কর্মীদের কর্মদক্ষতা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।’ (সূত্র : দৈনিক আমাদের সময়, তারিখ : ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬)। গবেষণার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ধীরে ধীরে আইসিটির ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় ব্যাংকের একজন কর্মী গড়ে ৪১ কোটি টাকা লেনদেন করতেন। সেটি ২০১৫ সালে প্রায় চার গুণ বেড়ে ১৬০ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ লেনদেন সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে একজন কর্মীর আর্থিক লেনদেনের দক্ষতাও এ সময়ে প্রায় চার গুণ বেশি বেড়েছে। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফাও এ সময় বেড়েছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বেসরকারি ও বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলো মুনাফা করলেও সরকারি ব্যাংকের লোকসানের কারণে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত লোকসানের মধ্যে ছিল। সেই অবস্থা থেকে ২০০০ সালে ব্যাংকিং খাতের গড় মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৫ কোটি টাকা। এ মুনাফা ২০১৫ সালে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। (সূত্র : দৈনিক যুগান্তর, তারিখঃ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬)।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ে কেন এতো হতাশা? আর কেনই বা বেসরকারি ব্যাংকের সাথে পাল্লা দিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো আধুনিকায়ন হয়ে চলতে বা সেবা দিতে পারছেনা? না সরকার চাইলেও বিশেষ ব্যক্তি বা মহল চাচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি? আসলেই কি উত্তর হওয়া সম্ভব? হ্যাঁ, অবশ্যই সম্ভব। কথায় বলে- ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। ঢেলে সাজাতে হবে সরকারি অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টর। আমাদের সরকারের উচচ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যদি একটু মানসিকতা পরিবর্তন করেন তাহলেই এই সমস্যা থেকে উত্তরণ হওয়া সম্ভব; তারা যদি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মতো নিজেদের প্রতিষ্ঠান মনে করে আন্তরিকতার সহিত কাজ করেন তাহলেই এই সমস্যা থেকে উত্তরণ হওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের আইসিটি বিষয় প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নতুন করে নিয়োগের ক্ষেত্রেও আইসিটি বিষয় দক্ষ কর্মীদের নিয়োগ দেয়া দরকার।

পরিশেষে বলতে চাই, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে। এ অবস্থা থেকে আইসিটির কারণে ব্যাংকিং খাতে নতুন অনেক সেবা এসেছে, কর্মদক্ষতা বেড়েছে। সে অনুযায়ী সরকারি ব্যাংক অনেকটা পিছিয়ে। এ অবস্থায় প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। এমন নীতি অবলম্বন করা প্রয়োজন। এভাবে চলতে থাকলে অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টরে সরকার অনেক পিছিয়ে থাকবে। ফলে পিছিয়ে পড়বে গোটা দেশ। বিশ্বের কাছে সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের জোড়ালো ভূমিকা নেওয়া উচিত।

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক।