কাজী নজরুল ইসলাম, শরীয়তপুর থেকে : কিছু দূর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সরকারি তহবিলের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভয়ংকর এক সিন্ডিকেটের সদস্যরা। অধিগ্রহনকৃত ভূমির উপর বিভিন্ন ঘর দরজা, অবকাঠামো নির্মাণ ও গাছপালা লাগিয়ে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে এলাকার প্রভাবশালী অসাধু এই চক্র। দূর্নীতি প্রতিরোধের অনুরোধ জানিয়ে স্থানীয়রা আবেদন করলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি জেলা প্রশাসন। উল্টো সিন্ডিকেটকে টাকা পাইয়ে দিতে ক্ষতিগ্রস্তদের নামে ৭ ধারার নোটিশ প্রদান করেছে জেলা প্রশাসন।

স্থানীয় সূত্র ও শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক কার্যলয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানকল্পে ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড এর স্থায়ী সেনানীবাস নির্মানের জন্য পদ্মা সেতু এলাকার জাজিরা পয়েন্টে একটি স্থায়ী সেনানীবাস নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেন ২০১৫ সালের প্রথম দিকে। এরপর পদ্মাসেতুর জাজিরা অংশের ল্যান্ডিং পয়েন্টের পূর্ব পাশে ১০১ নং নাওডোবা মৌজায় এল এ ৮ নং কেস এর মাধ্যমে ১ শত একর ভূমি অধিগ্রহন করা হয়। অধিগ্রহনকৃত ভূমিতে শত শত অবৈধ ঘর নির্মাণ, গাছপালা লাগানো ও পুকুর খনন করে স্থানীয় একটি চক্র। তারা নামে বেনামে, জমির মালিক না এমন ব্যক্তির নাম দেখিয়ে, মাদারীপুর, ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ ও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে এমন আত্মীয় স্বজনদের নামে ঘর তোলেন। এতে ৩ শত ৬৩ জনের নামে ২৩ কোটি ৫৩ লক্ষ ১১ হাজার ৫ শত ৫২ টাকার বিল জমা দেয় গণপূর্ত বিভাগ (চেক প্রদানের সময় এর সাথে যোগ হবে আরো ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ১১ কোটি ৭৬ লক্ষ, ৫৫ হাজার ৭ শত ৭৬ টাকা, মোট =৩৫ কোটি ২৯ লক্ষ ৬৭ হাজার ৩ শত ২৮ টাকা)। অনুরূপভাবে একই ভূমিতে ১ শত ৮৫ ব্যক্তির নামে গাছ পালার ক্ষতিপূরনের তালিকা করে সেখান থেকে ১৮ কোটি ২৬ লক্ষ ২৩ হাজার ২ শত টাকা পাইয়ে দিতে স্থানীয় বন বিভাগ একটি তালিকা প্রেরণ করেন ( এরসাথে যোগ হবে আরো ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৯ কোটি ১৩ লক্ষ ১১ হাজার ৬ শত টাকা, মোট= ২৭ কোটি ৩৯ লক্ষ ৩৪ হাজার ৮ শত টাকা)। সর্বমোট ৬২ কোটি ৬৯ লক্ষ ২ হাজার ১ শত ২৮ টাকা বেহাত হচ্ছে সরকারের কোষাগার থেকে। আর এ কাজে পুরোটাই সহায়তা জুগিয়েছে সরকারের জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত ও বন বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফসলি জমিতে ভিটা বেধে সেখানে সাড়ি সাড়ি ঘর তোলা হয়েছে। আইনজীবী থেকে শুরু করে প্রভাবশালীরা একেক জনের নামে ৩ থেকে ৭টি করে ঘর তুলে ফেলে রেখেছে। বেশীরভাগ ঘরেই তালা ঝুলছে। ৯ সদস্যের সিন্ডিকেটের প্রতি সদস্য নামে বেনামে ২৫-৩০ টি করে ঘর তুলে, গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তাদের মোটা অংকের টাকা উৎকোচ দিয়ে প্রকৃত মূল্য থেকে ৫/৬ গুন বেশী টাকা লিখে বিল করিয়েছেন। অপর দিকে ধান ক্ষেতের মধ্যে পাট শলার মত সরু বিভিন্নœ গাছের চারা রোপন করে একেকটি চারা গাছের বিপরীতে ২ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্য নির্ধারণ করে বিল প্রস্তুত করে জমা দেয়া হয়েছে। এতে কমকর্তারা মোটা অংকের টাকা কমিশন নিয়েছে বলেও জানা গেছে।

এই কোটি কোটি টাকা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি জানতে পেরে গত ১৮ জানুয়ারী স্থানীয় আবুল কালাম খান নামে এক ব্যক্তি বিষয়টি তদন্ত পূর্বক ক্ষতিপূরনের ন্যায্য টাকা পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে শরীয়তপুরের জেলা প্রশসাক বরাবরে একটি আবেদন করেন। জেলা প্রশাসক গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে বিষয়টি তদন্ত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। এরপর এ বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি হয়েছে বলে কিছু জানা যায়নি।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মতিউর রহমান চুন্নু ঢালী, গোলাম মূর্তজা ওরফে ফারুখ ঢালী, সাত্তার ঢালী, ইউপি সদস্য দাদন ঢালী, রুবেল ঢালী, লাল মিয়া মোলঙ্গী, নুর মোহাম্মদ ঢালী, সালাম হাওলাদার, বাবুল হাওলাদার ও নাজমুল মোল্যার সমন্বয়ে একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা সেনানীবাস নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহনের খবর পেয়ে ফসলী জমিতে ভিটা বেধে ঘর দরজা তুলতে শুরু করে। তারা সামাজিক বনায়নের নামে সরকারি টাকা হাতিয়ে নিতে ফসলী জমিতে বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছের চারা রোপন করে। জমি অধিগ্রহনের আগে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যৌথ জরিপের সময় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, গণপূর্ত বিভাগ ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে মোটা অংকের চুক্তি করে অবৈধ স্থাপনার বিপরীতে কোটি কোটি টাকার বিল প্রস্তুত করে।

সরেজমিন অনুসন্ধান করে ও তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্য সংগ্রহ পূর্বক জানা গেছে, ১০১ নং নাওডোবা মৌজার শুধুমাত্র ৪৬৫৪ নং দাগেই ২৪ জনের নামে বিধি বহির্ভূতভাবে ঘর দরজা তুলে সেখান থেকে ৩ কোটি ৫৯ লক্ষ ৫৭ হাজার ৪ শত ৯৫ টাকা ৫০ পয়সা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। একই দাগে ১১ ব্যক্তির নামে গাছ পালা দেখিয়ে সেখান থেকেও হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ৯৪ লক্ষ ১৯ হাজার২ শত ৫০ টাকা। নাওডোবা তহশীল অফিস সূত্রে জানা গেছে ৪৬৫৪ নং দাগের সম্পূর্ন জমির শ্রেনিই নাল। কিন্তু এখানে ভিটে বাড়ি দেখিয়ে ঘর তোলা হয়েছে। আরো জানা গেছে, এই জমির ওয়ারিশ না, এমন ব্যক্তিদের নামেও এখানে স্থাপনার বিল করা হয়েছে। সরেজমিন গিয়ে এখানে ১০ হাজার টাকা মূল্যের গাছের সন্ধানও পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে আরো বেরিয়ে এসেছে, ৪৩০৫ নং দাগে ১ একর ২৭ শতাংশ জমি রয়েছে। জমির শ্রেনী নাল। জমির মালিক মোট ৯ জন। এই জমি থেকে অন্তত ২ বিঘা পরিমান জমিতে বাবুল খান গাছ লাগিয়ে সেখানে প্রায় দেড় কোটি টাকা বিল তৈরী করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ বাবুল খানদের তিন ভাইর নামে বিআরএস পর্চা অনুযায়ী এখানে জমি রয়েছে মাত্র ২১ শতাংশ।

জেলা প্রশাসকরে কার্যালয় থেকে পাওয়া বন বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত ১৮৫ জনের নামের তালিকা থেকে জানা গেছে সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তায় সরকারি টাকা হাতিয়ে নেয়ার এক অবিশ্বাস্য ও ভয়ংকর তথ্য। এতে নুর মোহাম্মদ খানের ছেলে বাবুল খানের নামে ৭৮০টি মেহগনি গাছ দেখিয়ে ১ কোটি ৪০ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, আযূব আলী মাদবর ও তার স্ত্রী ফাহিমা বেগম এর নামে ৬৭০টি মেহগনি, ৪০টি আম ও ২০টি পেয়ারা গাছ দেখিয়ে ১ কোটি ৪২ লক্ষ ৫ হাজার টাকা, নান্দু ঢালীর ছেলে সিন্ডিকেট সদস্য সাত্তার ঢালীর নামে একই তালিকায় দুই বার নাম লিখে ৪০০ মেহগনি ও ২০টি আম গাছ দেখিয়ে ১ কোটি ১৪ টাকা, আবুল হোসেন হাওলাদারের ছেলে সালাম হালাম হাওলাদারের নামে ২০০ টি মেহগনি গাছ দেখিয়ে প্রতিটির মূল্য ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা, রজ্জব আলী ঢালীর পূত্র আব্দুর রাজ্জাক ঢালীর নামে ২৬০টি মেহগনি, ২০টি নারকেল, ২২টি জাম, ৪০টি আম, ৪৫টি কাঠাল, ১৫টি লেবু, ২৮টি লিচু, ৪০টি আতা ফল, ২০টি কাউ গাছ ও ৫০০ বাঁশ দেখিয়ে ৯৩ লক্ষ ১০ হাজার ৫ শত টাকা, সাত্তার মোল্যার পূত্র সিন্ডিকেট সদস্য নাজমূল মোল্যা নামে ৬৪ লক্ষ ২০হাজার টাকা, শরীয়তপুর জজ কোর্টের আইনজীবী এপিপি আলমগীর হোসেন হাওলাদারের নামে ৩৫০টি মেহগনি গাছ দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ৬৩ লক্ষ টাকা। এমনি ১৮৫ ব্যক্তির নামে শুধু গাছের বিপরীতেই সরকারের কোষাগার থেকে বেহাত হচ্ছে ২৭ কোটি ৩৯ লক্ষ ৩৪ হাজার ৮ শত টাকা।

এছারাও গণপূর্ত বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত ৩৬৩ জনের নামের তালিকা অনুযায়ী ঘর দরজা সহ বিভিন্ন স্থাপনা অবকাঠামোর বিপরীতে ক্ষতিপূরনের নামে সরকারকে গুণতে হচ্ছে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই তালিকায় যাদের স্থায়ী বসবাস ঢাকা সহ দেশের ভিভিন্ন এলাকায় তাদের নামে ঘর তুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট। এখানে স্বামী-স্ত্রীর নাম, পিতা-পূত্রের নাম, মা- ছেলের নাম, পিতা ও নাবালক সন্তানদের নাম, দুঃসম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনের নামে সাড়ি সাড়ি ঘর তুলে সরকারি কোষাগার শুন্য করার ফন্দি আটা হয়েছে। অবৈধভাবে যে সকল ঘর ও স্থাপনার বিপরীতে সরকার কয়েকগুন টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে, সেকল ঘর ও স্থাপনা প্রত্যেকের প্রত্যেক মালিক নিয়ে যাবেন। এর বিনিময়ে সরকার তাকে ঘর অপসারনের খরচ বাবদ মূল্যও পরিশোধ করবেন। তাহলে হিসেবটা দাড়ালো যে, যার ঘর সে ফেরৎ পাবে, আবার সরকারি টাকায় তা ভেঙ্গেও নেয়া হবে। মাঝখান থেকে সরকারের গচ্চা গেল প্রায় সাড়ে ৩৬ কোটি টাকা।

অধিগ্রহনকৃত ১০০ একর জমি থেকে প্রায় ৭০ একর জমি নাল বা ফসলি এবং ভিটা বাড়ি দেখানো হয়েছে প্রায় ৩০ একর জমি। নাল জমির বিপরীতে জমির মালিকদের সরকার প্রতি শতাংশে ক্ষতিপূরন পরিশোধ করবে ৬০ হাজার টাকা। আর ভিটা বাড়ির বিনিময়ে প্রতি শতাংশে পরিশোধ করা হবে প্রায় ১ লক্ষ ২০ টাকা করে। এতে মোট ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারকে শুধু জমির মূল্যই পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রায় ১ শত ১৭ কোটি টাকা।

নাওডুবা মৌজার মৃত সরল খাাঁর পূত্র কালাম খান বলেন, আমাদের জমি জমা ইতিপূর্বে পদ্মা সেতুর জন্য সরকার অধিগ্রহন করেছে। বর্তমানে সেনানীবাসের জন্য জমি অধিগ্রন করা হয়েছে। সেখানে একটি সিন্ডিকেট ভূয়া বিল বানিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট করা খবর জানতে পেরে আমি শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন করি। আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে তদন্ত করে প্রকৃত মূল্য পরিশোধের জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু জেলা প্রশাসন কোন তদন্ত না করেই ভূয়া গাছ পালা ও অবৈধ স্থাপনার উপর টাকা পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

অবৈধ গাছ পালা ও ঘর দরজা তুলে টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সিন্ডিকেট সদস্য আব্দুস সাত্তার ঢালী বলেন, “ধান যতই পরিস্কার করা হোক তার মধ্যে কিছু চিটা তো থাকবেই। মনে করেন সেভাবেই আমরা কিছু অতিরিক্ত সুবিধা নিচ্ছি”।

শরীয়তপুর জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুধীর কুমার রায় এর কাছে এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি না হয়ে মুঠো ফোনে বলেন, “ যা করেছি তা এলাকার মানুষের স্বাথেই করেছি। এলাকার লোকেরা যদি কিছু টাকা বেশী পায় তাতে তো কোন সমস্যা নেই। তা ছারা ক্ষতিপূরনরে তো নির্ধারিত কোন রেট নেই”।

শরীয়তপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সালেহ মুহম্মদ ফিরোজ বলেন, জেলা প্রশাসনের রোকেরা যৌথ জরিপের পরে আমাদের কাছে ঘর দরজা সহ বিভিন্ন স্থাপনার মূল্য নির্ধারনের দিলে আমরা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করি। এখানে অবাস্তব কিছু করা হয়নি।

শরীয়রতপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, এক ব্যক্তি আমার কাছে একটি আবেদন করেছেন। আমি বিষয়টি একটি তদন্ত টিম গঠন করে তাদের মাধ্যমে পুনঃ তদন্ত করানোর ব্যবস্থা গ্রহন করবো।

(কেএনআই/অ/ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৭)