প্রবীর বিকাশ সরকার


জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই চলচ্চিত্রর সঙ্গে পরিচয় আমার। শিশুকালেই মার সঙ্গে সিনেমা হলে ছবি দেখেছি। অন্ততপক্ষে সাত বছর বয়স পর্যন্ত দেখার অভিজ্ঞতা আছে। ৭৬ বছর বয়সী মা এখনো সিনেমা দেখা আর বইপড়ার পাগল। মার জন্য আলাদা টিভি কিনে দিয়েছে তার মেজো মেয়ে প্রতিমা। আগে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখতো এখন টিভিতেই দেখে। কম্পিউটারে ডিভিডি চালাতে জানলে সেটাও করতো। মার সঙ্গে যে কত ছবি দেখেছি তার হিসেব নেই কিন্তু কি নাম, কি কাহিনী একদম মনে নেই। সেসব ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি ছবি দুটোই এবং পাকিস্তানি। মা বললো, তার দেখা শেষ ভারতীয় ছবি ‘মা’নায়ক ছিল ভারতভূষণ, রূপালী সিনেমা হলে দেখেছিল এবং আমিও সঙ্গে ছিলাম যদিও আমার ছবিটির কথা স্মরণে নেই। স্বাধীনতার পর মা কম গিয়েছে সিনেমা হলে। সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে হয়নি। তবে কম দেখেনি এটাও ঠিক।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কুমিল্লা শহরে যে তিনটি সিমেনা হল আমি দেখেছি তার দুটোই এখন বন্ধ এবং ভগ্নদশায় পরিণত। এগুলো হলো রূপালী, রূপকথা ও লিবার্টি। তিনটিরই বয়স শতবর্ষ না হলেও আশি ছাড়িয়েছে বলে আমার ধারণা। রূপালী এখনো ধুঁকে ধুঁকে চলছে। সংস্কার হয়নি বহুবছর ধরে। সম্প্রতি এর মালিক ফরিদ আহম্মেদ সাহেব জানালেন এটা এখন লুজিং কনসার্ন তাই ভেঙ্গে ফেলে বহুলতলবিশিষ্ট শপিং মল তৈরি করা হবে।

রূপকথার মালিক কি করবেন জানি না। লিবার্টি হলটি নিয়ে মামলা চলছে অনেক বছর ধরে। শোনা যায় এখানেও বহুতল দালান হবে। সরকারিভাবে না বেসরকারিভাবে হবে জানি না। শোনা যায় লিবার্টি ও রূপকথা দুটি হলেরই মালিক ছিলেন বহু বছর আগে ভারত থেকে আগত অবাঙালি শ্যামদাস ক্ষেত্রীরা। মাড়োয়ারি ক্ষেত্রীরা কুমিল্লা শহরে অনেক জায়গা ও বাড়ির মালিক ছিলেন। তারা স্বাধীনতার আগেই ভারতে চলে গেছেন বলে বিশিষ্ট কবি, গল্পকার ও সাংবাদিক গাজী মোহাম্মদ ইউনুসের ভাষ্য থেকে জানা যায়। লিবার্টি হলের ম্যানেজার ছিলেন বাদল কুমার চক্রবর্তী। স্বাধীনতার পর মালিক বলে দাবিদার বাদলবাবুর সঙ্গে প্রশাসনের দ্বন্দ্ব বাঁধে ফলে মালিকত্ব নিয়ে মামলা চলছে অনেক বছর ধরেই। বাদলবাবু এখন আর হলসংলগ্ন বাড়িতে থাকেন কিনা জানি না তবে বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায় তিনি এই শহরেই আছেন। তার ছোটভাই অটলদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি প্রতিদিন ভিক্টোরিয়া কলেজের ব্যায়ামাগারে সকাল বিকেল ব্যায়াম করতেন। খুব হাস্যরসিক মানুষ ছিলেন। এখন সরকারি মহিলা কলেজের কাছে জেরক্স কপির ছোট্ট একটি দোকান চালান।

বাদলবাবুও খুব ভালো মানুষ। তাকে অনুরোধ করে শহরের অনেকেই বিনামূল্যে ছবি দেখতেন। আমরাও ছাত্রাবস্থায় অনেকবার বাদলদাকে বলে ঢুকে পড়েছি সেকেন্ড ক্লাসে দুপুর তিনটার সময় ম্যাটিনি শোতে। তিনি চাঁদাও দিতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। সরস্বতী পুজোর চাঁদা নিয়েছি তার কাছ থেকে স্মরণে আছে। গোলগাল বেঁটে সদাহাস্যমুখ বাদলদার কথা খুব মনে পড়ে। ছোটবড় সকলের কাছেই তিনি বাদলদা। কোনো কাজে পুলিশ কোর্টে গেলে বাবাকে খুব সমীহ করতেন বলে বাবার বন্ধুদের কাছে শুনেছি। কোনো-কোনোদিন ভালো বা বিখ্যাত ছবি এলে বাবা খবর পেত এবং টিকিটও পেত, কীভাবে পেত জানি না। বাবা জিজ্ঞেস করতো, পটুর মা ছবি দেখবে নাকি? এই নাও টিকিট। মা তো গদ গদ হয়ে স্বর্গে যাওয়ার টিকিটই পেয়ে গেল যেন এরকম অবস্থা! বাবা ছবি দেখতো না। কাজেই মা যেত আমাকে নিয়ে। এরকম একটা সংস্কৃতি ছিল এই শহরে বহু বছর ধরে।

১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কত যে ছবি আমি দেখেছি এই সিনেমা হলগুলোতে বন্ধুদের নিয়ে হিসেব করতে পারবো না। একসময় আমিও মার মতো সিনেমাপাগল হয়ে পড়েছিলাম। মার ছেলে বলে কথা! ছোট্টবেলায় ছবিতে মারামারি হলে মুখ লুকাতাম, রক্ত দেখলে চিৎকার করে উঠতাম ভয়ে আর দুঃখের সিন এলে ফিচ ফিচ করে কেঁদে ফেলতাম। সেইসব স্মৃতি ঢের মনে আছে। মাঝেমাঝে মা বিরক্ত হয়ে বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসতে বলতো। আমি সরু বারান্দায় গিয়ে বেঞ্চিতে বসে থাকতাম। আরও মহিলারা বসে থাকতেন পরবর্তী শো দেখার জন্য। বাইরে থেকে ছবির শব্দ, সংলাপ ও গান শোনা যেত বেশ স্পষ্টই। গান বেজে উঠলে দরজা ঠেলে পর্দা ফাঁক করে ঢুকে যেতাম, বসে পড়তাম মার কোলে। গানের পরপরই সচরাচর দুঃখের সিন চলে আসতো এবং আমিও যথারীতি বাইরে চলে আসতাম আবার। বারান্দায় ভিড় বাড়তে থাকতো। পরিচিত জনও থাকতেন দেখতাম। পরচিত মা-বৌরা এটা সেটা দিতেন আমাকে। আদর করে পাশে বসিয়ে রাখতেন। আমি বসে বসে বাদাম খেতাম, লজেন্স চুষতাম। হলের কর্মচারী সবাই মাকে এবং আমাকে খুব ভালো করে চিনতো। মা কি নতুন ছবি দেখছে নাকি! কিশোরী ছিল যখন তখন থেকেই ছবি দেখে আসছে। আমার দাদু জলধর সরকারও ছিল পুলিশ কোর্টের সাব-ইন্সপেক্টর বৃটিশ এবং পাকিস্তান আমলে। মাসি ও মাকে দাদু সিনেমা হলে বসিয়ে দিয়ে চলে যেত অফিসে আবার শেষ হলে পরে ফিরিয়ে নিতে আসতো বলে মার কাছে শুনেছি। তা ছাড়া পুলিশ কোর্টের জিআরও (জেনারেল রেকর্ড অফিসার) পরেশবাবুর স্ত্রীকে চেনে না এমন কেউ ছিল নাকি এই শহরে, কাপড়ের দোকান থেকে শুরু করে রাজগঞ্জের মাছবাজার পর্যন্ত! সুতরাং খারাপ লোকদের থেকে আমরা ছিলাম নিরাপদ। এমনকি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও। দু-একটি মাত্র হিন্দু পরিবার ছিল পুরো যুদ্ধের সময় তার একটি ছোটরায় বসবাসকারী সাব-ইন্সপেক্টর পরেশচন্দ্র সরকারের! আর সেটা বাবার পরোপকারের বদৌলতেই সম্ভব হয়েছিল।

ছবি চলার সময় বারন্দায় একাধিক ব্ল্যাকার ঘোরাফেরা করতো। কোনো-কোনো ব্ল্যাকার (যারা বেশি দামে টিকিট বিক্রি করতো অবৈধভাবে) মাকে দেখলেই লম্বা করে সালাম ঠুকতো, কারণ বাবুর স্ত্রী! ওদের তো প্রায়শ পুলিশ ধাওয়া করতো আবার মাঝেমধ্যে ধরে নিয়ে যেত থানায়। তারপর কোর্টে চালান দিত। আটকে রাখা হতো হাজতঘরে। তাদের আত্মীয়স্বজন বা বৌরা এসে কান্নাকাটি করতো কোর্টে, বাবা দয়াপরবশ হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে বলে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করতো। শুধু কি সিনেমা হলের ব্ল্যাকার, ছোটোখাটো মজুতদার, চোরাকারবারী, রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকেও বাবা কত যে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে সেসব আরেক ইতিহাস।

অনেক সময় সিনেমা হলের বারান্দায় বসে থাকতে দেখে ব্লেকাররা চকোলেট এনে দিত আমাকে। কারণ এরা আমাকে চিনতো এবং বাবার অফিসে অনেকবার দেখেছে। ‘ছোটোবাবু’আদাব বলে সেলামও করতো আমাকে। আমি সময় কাটাতে দোতলার বারান্দা থেকে দেখা যায় আশেপাশের বাড়িঘরগুলো দেখতাম। কী সবুজ আর ছিমছাম সুন্দরই না ছিল কুমিল্লা শহরটি! ছবি শেষ হলে পরে আমরা রিকশায় চেপে বাসায় ফিরতাম। ফেরার সময় হলসংলগ্ন পানের স্টল থেকে ছবির গানের চটিবই কিনে নিত মা। তাতে ছবির কাহিনী ও গানগুলো মুদ্রিত থাকতো। ছবি ভাঙলে পরে প্রচণ্ড ভিড় হতো, মহিলা আর মহিলা ছাড়া কিছুই দেখা যেত না! প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি আর হৈরৈ গুঞ্জন। মা আমাকে শক্তকরে ধরে রাখতো আর ইতিউতি তাকাতো ফটকের বাইরে। তখন বাদশা মামাও আমাদেরকে খুঁজছেন দেখতাম। তিনি আমাদের প্রতিবেশী রিকশা চালান। তার রিকশায় করে যেমন ছবিঘরে যেতাম আবার ছবি শেষ হওয়ার পর তার রিকশাতে চড়েই বাসায় ফিরতাম। তখন সন্ধে গড়িয়ে যেত। অনেক সময় মা পাড়ার মাসি বা বান্ধবীদের সঙ্গে রাতের শো দেখতে যেত। বাবা ও আমি বাসায় থাকতাম। বাদশা মামা নিয়ে যেত। ভাড়া দিত বাবা। সত্যিকথা বলতে কী, আসলে পাড়ার গরীবরা বাবার ওপরই চলতো তখন। ছোটরা এলাকাটায় বিহারী কলোনী ছিল। মফিজাবাদ কলোনী নামেই খ্যাত। সবাই ছিল খুব গরীব দিনে এনে দিনেই খাওয়া লোকজন। বাবার অফিস সংলগ্ন আবার এই কলোনী। (আমার লিখিত ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’ উপন্যাসে এসব বর্ণনা আছে, এখনো বই হিসেবে অপ্রকাশিত।)

মনে পড়ে যখন একটু বড় হলাম তখন অনেক কিছুই বুঝি বয়স তখন ৯-১০। পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতার পরেও ইংলিশ ছবি দেখানো হতো তিনটি হলেই। তবে লিবার্টি হলেই বেশি দেখেছি। রবিবারে সকালে গিয়ে ছবি দেখতাম একেবারে থার্ড ক্লাসে পর্দার সামনে বসে। গম গম করতো শব্দ। মানুষগুলোকে বড় বড় দেখা যেত এবং তাদের দুর্দান্ত অভিনয় দেখে আবেগে উত্তেজিত হয়ে পড়তাম। নায়ক যখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতো ঘুষি দিয়ে বা বন্দুক দিয়ে গুলি করে কী পুরুষালীই না লাগতো তাকে! আমরা বন্ধুরা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিতাম! শিশ দিত দুষ্টু লোকেরা। পেছন থেকে দর্শকদের ধমক খেতাম উঠে দাঁড়ানোর জন্য। তখন বেশির ভাগ দেখানো হতো কাউবয় মানে ওয়েস্টার্ন পিকচার। তা ছাড়া সামাজিক ও ডিটেকটিভ ছবিও দেখানো হতো। ততদিনে মারামারির দৃশ্য দেখে সয়ে গেছে। বুঝতে পারছি যে এগুলো মানুষের বানানো নাটক বাস্তব নয়। মাঝেমাঝে মর্নিং শোতে স্কুলের শিক্ষকদের মুখেও পড়ে যেতাম। তখন ভোঁ দৌড়। অবশ্য তারা স্কুলে ভুলেও কিছু বলতেন না।

একবার শিশু-কিশোর সংগঠন কুমিল্লা ধর্মসাগর পাড় চাঁদের হাটের সম্মেলন করার জন্য অর্থ তহবিল গঠনার্থে চ্যারিটি শোর আয়োজন করা হয়েছিল। বাদলদা অনুমোদন দিয়েছিলেন একটি ইংরেজি ছবি দেখানোর। সপ্তাহ খানেক দেখানো হয়েছিল বলে মনে হয়। ছবিটি কে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মনে নেই যতখানি মনে পড়ে হানিফ সংকেতই ছবিটি ঢাকা থেকে এনেছিলেন দাদুভাইয়ের মাধ্যমে। তখন হানিফ সংকেত কুমিল্লাতেই থাকেন, ১৯৭৬-৭৭ সালের কথা। আমার লেখালেখির হাতেখড়ি তার কাছেই।

সমকালীন ইতিহাস লেখার ঐতিহ্য বাঙালির নেই। উৎস, দলিলপত্র, প্রমাণাদি যত্ন করে রাখার প্রবণতাও নেই। এই বিষয়ে বাঙালির উদাসীনতা নিদারুণ পীড়াদায়ক। অথচ এটা খুবই জরুরি। তথ্য না থাকলে ইতিহাস লেখা যেমন সম্ভব নয় তেমনি আধুনিকতাও গড়ে ওঠে না। কুমিল্লা এখন যাচ্ছেতাই একটা বাজে শহরে পরিণত হয়েছে। এই তিনটি সিনেমা হল মুছে যাওয়ার প্রতীক্ষায় নীরবে কাঁদছে। অথচ কত সুন্দরভাবেই না এগুলোকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা হিসেবে রিনোভেট করা যায় সংস্কারের মাধ্যমে। জাপানে দেখেছি পুরনো প্রেক্ষাগৃহগুলোকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করতে। নাগরিক সংস্কৃতি এখনো আধাশহর-আধাগ্রাম বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি এটা হতাশাব্যঞ্জক। হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত বহু মূল্যবান প্রাচীন, পুরনো ঐতিহ্যবাহী নকশাসমৃদ্ধ স্থাপনা, প্রতিষ্ঠান যেগুলো হতে পারে ভবিষ্যৎ পর্যটন শিল্পের অর্থকরী সম্পদ। এইসব সাংস্কৃতিক সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণই হচ্ছে লকলকিয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠা নাবালক আত্মঘাতী রাজনীতি। যে কারণে বর্তমান রাজনীতিকরা সংস্কৃতি বিরোধী।

লেখক : জাপান প্রবাসী ও গবেষক