আল আমিন


বান্দরবান এসে প্রথম দিন আমরা নিলাচল, মেঘালয়, লাবনি ঝর্ণা ঘুরেছি। ২য় দিন আমাদের প্লান ছিল আমরা নীলগিরি, শৈলপ্রপাত ঝর্ণা আর চিম্বুক পাহাড়ে যাব । বান্দরবনে আরো কিছু সুন্দর সুন্দর দেখার মত জায়গা ছিল বাট অর্থ এবং সময়ের সংকটের ফলে লিস্টে থেকে বাদ দিয়েছিলাম আগে। কারণ এখনো রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি যেতে হবে।

আগের দিন ঘুরাঘুরি করে অনেক ক্লান্ত। তাই রাতে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কারন আগামিকাল খুব ভোরে উঠতে হবে। নীলগিরিতে যত সকাল সকাল যাবেন তত মেঘ বা কুয়াশা ভালভাবে উপভোগ করতে পারবেন। নীলগিরিসহ অন্য জায়গা গুলোতে যাবার জন্য আমাদের ডাইভার সুজন ভাইকে ফোন দিলাম রাতেই। বললাম আমরা খুব ভোরে বের হব। ভাড়া কত নিবেন। বলল ২৫০০ টাকা। আমরা বললাম ভাই এত বেশি ভাই, একটু কম নেন ।বলল আপনারা যেহেতু আজ আমার গাড়ি নিয়েছিলেন তার জন্য ২২০০ হলে যেতে পারব। আমরা আগে অন্য গাড়িতে খোজ নিয়েছিলাম মহেন্দ গাড়ি গুলো ২৫০০-৩০০০ নিবে। তাই সুজন ভাইকেই কনফার্ম করলাম।কারন সে ছিল উপজাতি, এতে একটু বাড়তি সুবিধা আছে আবার ভাল মনের মানুষ।

রাতে ডা. রাশেদুল হাসান রিপন ভাই ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিলেন কোথায় কোথায় ঘুরলাম। তিনি বললেন বান্দরবন দেখা হয়ে গেলে তোমরা রাঙামাটি ,খাগড়াছড়ি না গিয়ে কক্সবাজার চলে যাও। কারণ ওই গুলো বান্দরবনের মতই।ব ললাম যে কাল নীলগিরি থেকে ঘুরে আসি তারপর দেখি ভাই কোন দিক যাব কারণ আমাদের ঢাকা থেকে প্লান করা আমরা বান্দরবন, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িতে যাব। পরের দিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমাদের ড্রাইভার সুজন ভাইয়ের ফোনে ঘুম ভাঙল ছয়টার মধ্যে রেডি হয়ে হালকা নাস্তা করে গাড়িতে উঠলাম।

নীলগিরি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র। এ পর্যটন কেন্দ্রের উচ্চতা প্রায় ২২০০ ফুট। এটি বান্দরবান জেলার থানছি উপজেলায় অবস্থিত। বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত এই পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তায় খুব মজা করতে করতে বেসুরো গলায় গান গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম পাহাড়ের নিচ দিয়ে সাদা সাদা কি যেন ভাসছে। গাড়ি থামাইতে বললাম। নেমে যা দেখলাম তা অবাক হবারই মত। দেখলাম মেঘ আমাদের নিচ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। এটা দেখে যে আমাদের কি অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। আমরা চার জন বন্ধু আনন্দে চিৎকার শুরু করলাম। তারপর কিছু ছবি উঠালাম।


সুজন ভাই বলল নীলগিরি থেকে আরো ভাল ভাবে দেখা যায়। আবার আমরা চলা শুরু করলাম।কিছুদুর যাওয়ার পর সেনা ক্যাম্প, সেখানে নাম এন্ট্রি করে যেতে হয়। পাশেই সেনা ক্যান্টিন। ওখানে নাস্তার জন্য কলা রুটি কিনছিলাম। আমাদের ভাষা শুনে একজন সেনা সদস্য যিনি ক্যান্টিনে ডিওটি করছিল তিনি জানতে চাইল বাসা কোথায়। বললাম কুষ্টিয়া। উনি বলল কুষ্টিয়ার কোথায়। বললাম দৌলতপুর, ফিলিপনগরে। সে বলল আমার বাড়ি চিলমারিতে। শুনে খুশিই হলাম কারণ এলাকার ভাই। তার নাম রনি। তিনি বললেন নীলগিরি থেকে ফেরার পথে দেখা করে যেতে। তারপর আবার গাড়িতে উঠলাম।সাড়ে ৮টার সময় আমরা নীলগিরিতে পৌছাইলাম।তখন সূর্য উঠে গেছে ভাল ভাবে।তারপর ও আমরা অনেক উপরে ।তাই তাপ টা একটু বেশিই লাগছিল।

নীলগিরিতে প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা এবং সাথে গাড়ি থাকলে তার পার্কিং ভাড়া ১০০ টাকা। প্রবেশের পূর্বে পাশে পাহাড়িদের ফলমূলের দোকান। সেখানে সব কিছুই টাটকা এবং ফরমালিন মুক্ত। আমরা পেঁপে, কলা খেয়ে নিলাম। দাম ঢাকার মতই।

নীলগিরিতে ঢুকেই সে এক অন্য রকম অনুভূতি। আমাদের নিচ দিয়ে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছা করলে হাত দিয়ে ছোঁয়া যাচ্ছে। যেদিকে তাকাবেন সেদিকে শুধু পাহাড় আর মেঘের মিতালি। এর মাঝে আমরা। সেখানে অনেকগুলো থাকার জন্য কটেজ।

নীলগিরিতে প্রায় ৩ ঘন্টা অতিবাহিত করার পর আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম বান্দরবনে ফেরার পথে। ফেরার পথে পরবে চিম্বুক পাহাড় যেটা বাংলাদেশের ৩য় উচু পাহাড় আর শৈল্যপ্রপাত। ফেরার পথে সেনা ক্যান্টিনে রনি ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। ভাই আমাদের আপ্যায়ন করলেন। তারপর বিদায় নিয়ে চিম্বুকের উদ্দেশে যাত্রা। নীলগিরি থেকে ২৫ কিমি বান্দরবনের দিকে চিম্বুক পাহাড় অবস্থিত।

চিম্বুকে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমেই উপজাতিরা হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র বিক্রি করছিল, ওখান থেকে হাতে তৈরি চারটি চাদর এবং আরো কিছু জিনিস কিনলাম। উপজাতি মহিলারা এগুলো বানায় এবং তারায় বিক্রি করছে। চিম্বুক পাহাড়ে উঠে আশানুরূপ ভাল লাগল না। সংস্কারের কাজ চলছে। মিনিট বিশেক থেকে নেমে আসলাম। নেমে চা খেয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম। এবার যাব শৈল্যপ্রপাত ঝর্ণা। এটাও বান্দরবন ফিরার পথে একই রাস্তায়। চিম্বুক পাহাড় হতে ১৫ কিমি বান্দরবনের দিকে ঝর্ণাটি অবস্থিত।

যেতে যেতে পাহাড়ে ঢালে পাহাড়ি আনারস লাগানো দেখলাম। সুজন ভাইকে বললাম ভাই আনারস খাব একেবারে ফ্রেস যেটা ইনিস্টেন তুলে দিবে আমাদের। বলল ঠিক আছে, কিছুদূর গিয়ে একটা বাড়িতে থামালো। বাড়ির সাথেই দোকান ।ভাই দোকানদারকে বলল আনারস দেন তুলে এনে। দোকানদার বলল পার পিস ৬০ টাকা। আমরা বললাম ঠিক আছে। একটা বড় সাইজের আনারস নিয়ে আসল যেটা দেখে মনে হচ্ছিল ঠক হবে বাট কেটে দেবার পর খাওয়ার সময় অনেক মিষ্টি এবং রসালো ছিল। আমাদের বাজারে যেগুলা কিনে খায় তার থেকে পুরাই ভিন্ন। অনেক সুস্বাদু ছিল। এখনো মনে হয় মুখে লেগে আছে। একটা আনারস পাঁচ জন খাইতে পেট ভরে গেল।তারপর গাড়ীতে উঠালাম। পথে উপজাতি মহিলারা পিটে ঝুড়ি (পিঠে মালামাল বহনের জন্য) নিয়ে কাজে যাচ্ছিল। আমাদের ও ইচ্ছা হল তাদের ঝুড়ি আমরাও পিটে নিয়ে ছবি তুলব। সুজন ভাই একজন মহিলাকে তাদের ভাষায় ঝুড়িটি চাইল। তারপর আমরা কিছু ছবি তুলে আবার রওনা হলাম শৈল্যপ্রপাত ঝর্ণার উদ্দেশে।

প্রায় আধা ঘন্টার মধ্যে আমরা ঝর্ণায় পৌছে গেলাম।তখন ছিল শুষ্ক মৌসুম তাই ঝর্ণার পানি খুব একটা ছিল না। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে পানি। এটা অনেক বড় ঝর্ণা। সেখানে ১ ঘন্টা মত ছিলাম।তারপর হোটেলের উদ্দেশে যাত্রা। হোটেলে পৌছাইতে ৪টা বেজে গেলে। গাড়ী থেকে নেমে সুজন ভাইকে বিদায় দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার বের হলাম পাহাড়ে চড়তে। আমাদের হোটেলের পিছনেই ছিল একটা উচু পাহাড়। সেই পাহাড়ের উপর বাড়িও ছিল।পাহাড়ে উঠে কিছুক্ষন ঘুরাঘুড়ি তারপর সন্ধ্যায় হতে হতে নেমে আসলাম।সন্ধ্যার পর আবার বার্মা মার্কেটে ঘুরাঘুরি।রাত ৯টার দিকে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ঢুকলাম।।তারপর আমাদের পরের দিনের গন্তব্য ঠিক করতে বসলাম এবং টাকা পয়সার অবস্থা হিসাব করতে লাগলাম।

আমরা ঢাকা থেকে নেট ঘেটে বান্দরবন,রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি সর্ম্পকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম।হিসাব করে দেখালাম যে বান্দরবনে আমরা যা দেখেছি মুটামুটী তাই ই রাঙামাটি ,খাগড়াছড়ীতেও তাই।আবার ডাঃ রিপন ভাই ও বলেছিল। তাছড়া আমাদের টাকার যা অবস্থা তাতে অই দুই জায়গার একটা জায়গায় যাওয়া সম্ভব। তাই ডিসিশন চেঞ্জ করলাম।

বান্দরবান থেকে আমরা অই দিকে না যেয়ে কক্সবাজার যাব। ডিসিশন ফাইনাল, বান্দরবন থেকে কক্সবাজারের গাড়ি সকাল বেলায়। ভাড়া ১৭০ টাকা। রাতেই টিকিট করে রাখলাম।

বান্দরবন নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। এটা একান্ত আমার অভিমত :
আমরা যে সাত টা জায়গায় ঘুরেছি সেটা ঢাকা থেকে গিয়ে হোটেলে একদিন থেকে একটু প্লানিং করে ঘুরলেই সম্ভব। আমরা ২দিন ছিলাম।

বান্দরবনে বাস থেকে নেমে ইজিবাইক, রিক্সা চালক সবাই এক একটা দালাল টাইপের। সবাই বিভিন্ন হোটেল থেকে কমিশন নেয়। বাস থেকে নেমে ১ মিনিট হাঁটলেই অনেক হোটেল পাবেন। হোটেলে অবশ্যই ভাড়া দামাদামি করে উঠবেন। নয়লে ঠকবেন।

মিনিমাম ৪ জন সদস্য হলে ট্ররে র খরচ কম হবে। ৪ জনের বেশি হলে আরো ভাল।

বান্দরবনে টাটকা ফল বেশি পাওয়া যায়। তাই ভাতের চেয়ে ফল বেশি খাবেন। এতে আপনার ঘুরাঘুরির এনার্জিও বেশি পাবেন।

উপজাতিদের সাথে ভাল ব্যবহার করবেন। খারাপ কিছু থেকে বিরত থাকবেন। উপজাতিরা টুরিস্টদের অনেক সম্মান করে।

রাত করে হোটেলের বাইরে বের না হওয়ায় ভাল।

অফ সিজনে গেলে খরচ অনেক কম হয়। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সিজন। তখন খরচ তুলনামুলক বেশি।

আর পরিশেষে আমার কাছে যা মনে হয়েছে তা হল, কেউ যদি মনে করেন বান্দরবন, রাঙামাটি আর খাগড়াছড়িতে এক সাথে যাবার কথা ভাবছেন তাদের জন্য আমি বলব আপনারা তিন জায়গায় না গিয়ে আগে বান্দরবনে যান। তারপর বান্দরবন দেখার পর ডিসিশন নেন। আমার মনে হয় বান্দরবন থেকে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি না গিয়ে কক্সবাজার ঘুরে আসুন।