মাসকাওয়াথ আহসান


পারভীন খান সাহেবের মেয়ে। শ্রমিক ধর্মঘটের সময়টাতে গাড়ী নিয়ে বের হতে ভয় পায়; যদি গাড়ী ভেঙ্গে দেয় ধর্মঘটিরা। ধর্মঘটিদের সাংঘাতিক দাপট। মানুষকে বাস-ট্রাকের নীচে পিষে মারবে; কিন্তু তাদের কিছু বলা যাবে না। হাজার হাজার "লাইসেন্স টু কিল" নিয়ে এখন লাখে লাখে ধর্মঘটি তৈরি হয়েছে। তাদের শুধু একটা দিকই ভালো; এরা গরু-ছাগল ভালো চেনে। স্বজাতি বলে গরু-ছাগলকে বাঁচিয়ে চলে ধর্মঘটিরা। আর তাদের লাইসেন্স পাবার পূর্বশর্ত স্বজাতি গরু-ছাগল চেনা। কিন্তু মানুষকে পিষে ফেলতে কোন অসুবিধা নেই তাদের। কারণ যারা আত্মীয় নয়; তাদের জন্য কোন মায়া-দয়া নেই তাদের। প্রতি দিনই পাঁচ-দশটা মানুষ মেরে দিয়ে রাতে দেশি খুশীজলে শোণিত ধারা মিশিয়ে উতসবে মাতে তারা। তাস-পিটায়; প্রমোদ বালকেরা গা টিপে দেয়; মানুষ মারার নেশাটা তেতে ওঠে তাতে।

পারভীন তাদের তাজমহলের মতো বিশাল প্রাসাদ থেকে হেঁটে বেরিয়ে এক ট্যাক্সি চালককে জিজ্ঞেস করে, শাহবাগ যাবেন!
ট্যাক্সিচালক বড্ড অহংকার দেখিয়ে চলে যায়। পারভীনের ভীষণ দিশেহারা লাগে। কীভাবে যাবে বুঝতে পারে না। এমন সময় হিরো আলম বাইক নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
--চলেন আপনাকে পৌঁছে দিই।

পারভীন অহংকার দেখিয়ে বলে, আপনার সাহস তো কম না। আপনি জানেন আমি কে! মাই ফাদার'স নেম ইজ খান। বাট হি ইজ নট আ টেরোরিস্ট।
ইংরেজি শুনে হিরো আলম ঘাবড়ে যায়। বাইক স্টার্ট দিয়ে কেটে পড়ে।
ওদিকে শহরের নানা জায়গায় ধর্মঘটিরা গাড়ী-এম্বুলেন্স ভাঙ্গছে। পুলিশ কর্মকর্তা চিতকার করে বলেন, টিয়ার গ্যাস ছাড়ো না কেন!
জুনিয়র কর্মকর্তা বলে, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে যারা হরতাল করেছিলো; তাদের ওপরে টিয়ারগ্যাস মেরে গ্যাস ফুরিয়ে গেছে স্যার।
--তাইলে অন্ততঃ পানি মারো।
--পানি ভয় পায় সুশীলেরা; এই কুশীল ধর্মঘটিরা পানিকে ভয় পায় না স্যার।

পারভীন অসহায়ভাবে শাহবাগের দিকে হাঁটতে থাকে। হঠাত দেখে মাথার ওপর আকাশে একটা হেলিকপ্টার; আর তার দড়ি বেয়ে নেমে আসছে অনন্ত জলিল। সে বলে, আই ইজ ফ্লাইং-শ্যাল ইউ ফ্লাই।
পারভীন মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, হাউ ডেয়ার ইউ। মাই ফাদারস নেম ইজ খান এণ্ড হি ইজ নট আ টেরোরিস্ট।

অনন্ত জলিল মন খারাপ করে হেলিকপ্টারে উঠে যায়। পারভীন হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটা কফিশপে একটু বসে। একটা কফির অর্ডার দেয়।
কফি শপের প্রতিটি টেবিলে বসে সবাই খান সাহেবের সমালোচনা করছে। এই ধর্মঘটিদের আস্কারা দিয়েছেন মি খান। এ ব্যাপারে সবাই একমত। দ্বিমতের জায়গাটা ভিন্ন। সরকারের ঘোরসমর্থকদের ঘোরের একটা হোমওয়ার্ক সব সময়ই করা থাকে। খান সাহেবের বর্তমানকে ঢেকে রেখে জাস্টিফিকেশানের টাইম মেশিনে চড়ে চলে যায় আজি হতে বহু যুগ আগে। ঘোরে থাকাদের একজন বলে, এই খান সাহেব আমাদের দলের লোক না। একসময় তিনি অন্যদলে ছিলেন।

তার সমর্থনে আরেকজন ঘোর ভাইয়া চট করে স্মার্ট ফোন চটকে দেখিয়ে দেয় একটা মিছিলের ছবি। বর্তমানে প্রতিপক্ষের নেত্রীর মিছিলে আজি হতে কয়েক যুগ আগে খান সাহেব অংশ নিয়েছিলেন। দেশপ্রেম সমিতির গবেষক লাল গোল করে মার্ক করে দিয়েছে খান সাহেবের মুখমণ্ডল।

আরেকজন ঘোরদা সাক্ষী দেয়, খান সাহেবের পূর্বপুরুষ জামায়াত-শিবির ছিলো। ব্যাস ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব খালাস। এই খাল্লাসশৈলীতে খান সাহেব অন্য দল থেকে অনুপ্রবেশকারী। গত আটটা বছর ধরে যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোলে চড়ে গভীর প্রশ্রয়ে এতো মানবতাবিরোধী অপরাধ খান সাহেব করে ফেললেন; সেটা নিয়ে ঘোরচক্রের টু-শব্দ নেই। ঘোরচক্রের যাবতীয় জাস্টিফিকেশানের রাজা "ষড়যন্ত্র মামা"।

এমনকী যে খান সাহেবের বাসায় ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়; তিনিও দেখা যায় কফিশপের ঝুলন্ত টিভি স্ক্রিণে সাংবাদিকদের একই ষড়যন্ত্র মামার জাস্টিফিকেশান দিচ্ছেন। "ধর্মঘটের মধ্যে জামায়াত-শিবির ঢুকে গেছে।"

কফিশপের ঘোরচক্র গর্ববোধ করে, যাক খান সাহেবের হোমওয়ার্ক করা আছে।

আরো গর্বিত পারভীন উঠে দাঁড়িয়ে বলে, হি ইজ মাই ফাদার, হিজ নেম ইজ খান এণ্ড হি ইজ নট আ টেরোরিস্ট।

এতোক্ষণ যারা খান সাহেবের সমালোচনায় কফিশপ জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো; তারা সবাই এসে রিকুয়েস্ট করে, জাস্ট একটা সেলফি তুলবো আপা।

লেখক : জার্মান প্রবাসী সাংবাদিক।