প্রবীর বিকাশ সরকার


টোকিওর কুদানশিতা শহরে রয়েছে শিন্তোও ধর্মীয় মন্দির ইয়াসুকুনি জিনজা। নয়নাভিরাম প্রশস্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আলোকিত এই মন্দিরের প্রাঙ্গণে রয়েছে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখানে নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী পণ্যসামগ্রী যেমন বিক্রি হয় আবার দু’দণ্ড বিশ্রামও নেয়া যায়, হালকা খাবার ও পানীয় গ্রহণ করে। আমার খুব প্রিয় এই জায়গাটা। মাঝেমাঝে গিয়ে বিয়ার বা নিহোন শুউ (জাপানি মদ) পান করি আর জাপানিদের সঙ্গে কথা বলে আড্ডা দিই। সেদিন অনুজপ্রতীম বন্ধু কবি মিল্টনকে নিয়ে গিয়েছিলাম।

মিল্টন এই প্রথম এই মন্দিরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করলো। বললো, এই মন্দির তো বিতর্কিত! কিন্তু আমার দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। কত যে তর্ক-বিতর্ক-হৈ-হল্লা হয়েছে পত্রপত্রিকা আর টিভিতে আমি পড়েছি এবং দেখেছি।

আমি বললাম, এই পৃথিবীতে সবই বিতর্কিত, মানুষ বলো আর বস্তু বলো। মানুষ নাকি আগে বান্দর ছিল ফলে তার স্বভাবে বাঁদরামি, ইতরামি রয়ে গেছে। পৃথিবী নাকি বিগব্যাঙের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে---এই নিয়েও তো কত বিতর্ক। বিতর্কিত বিষয়ের মজাই আলাদা।

তাকে আরও বললাম, বিতর্কের জায়গায় বিতর্ক থাকুক---তার মধ্যেও যে আনন্দ আছে, জানার আছে, দেখার আছে সেটাকে উপলব্ধি করাই বুদ্ধিমানের কাজ। প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো এই মন্দিরটির আভিজাত্য আছে। এটা মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২) সম্রাট মেইজি নির্মাণ করান। এর আগের নাম ছিল ‘শোওকোনশা’---মূলত যাঁরা বিভিন্ন যুদ্ধে জীবনদান করেছেন সেইসব বীরদের আত্মাকে এই মন্দিরে শিন্তোও ধারায় সমাহিত করার জন্য। এমনকি, যুদ্ধে যেসকল পশুপাখি মৃত্যুবরণ করেছেন মর্যাদার সঙ্গে তাদের আত্মাকেও বাদ দেয়া হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইম্পেরিয়াল সেনাবাহিনী এই মন্দিরে প্রার্থনা করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মাতৃভূমিকে রক্ষাকল্পে। কাজেই এটা যুদ্ধমন্দিরও বটে।

তথাকথিত টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে (১৯৪৬-৪৮) দণ্ডপ্রাপ্ত প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকিসহ অন্যান্য সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আত্মাকে সমাহিত করা হয়েছে। তুমি তো জানো, কোরিয়া এবং চীনের সঙ্গে যুদ্ধ, উপনিবেশ স্থাপন, মানুষ হত্যা, অত্যাচার বিষয়ে জাপানের সঙ্গে ঘোরতর মতবিরোধ বিদ্যমান। তাই যখন জেনারেলদের আত্মাকে এখানে সমাহিত করা হলো তখন জাপানের ভেতরে মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল রুশ-চীনা বামপন্থী রাজনৈতিক দলের রাজনীতিকদের মধ্যে। তা সত্ত্বেও সম্রাট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মন্দিরে প্রতিবছর আগস্ট মাসে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনস্বরূপ যেতেন। এই নিয়ে প্রকাশ্য বাদানুবাদ কিছুই হয়নি। ১১৯৭৮ সালে প্রভাবশালী বামধারার দৈনিক পত্রিকা আসাহিশিম্বুন নাকি ষড়যন্ত্র করে চীনাদের ক্ষেপিয়ে তোলে সম্রাটের ইয়াসুকুনি মন্দির পরিদর্শনকে কেন্দ্র করে। সেই থেকে সম্রাট আর এখানে আসেননি। এখনো নয়। প্রধান মন্ত্রীরাও ১৫ আগস্ট না এসে অন্যদিনে প্রার্থনা জানাতে আসেন। তবে যদি রিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ক্ষমতায় থাকে। অন্য দলের কেউ আসেননি দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া। আসলে এই মন্দির নিয়ে জাপানি জাতি এখন দু’ভাগে বিভক্ত। যেমনটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশীরা দু’ভাগ হয়ে আছে অনেকটা তেমনি। মজার ব্যাপার কি জানো, জাপানি আর বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক মিল আছে।

আমার লিখিত ‘জানা অজানা জাপান’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে এই মন্দির নিয়ে একটি প্রবন্ধ আছে সেখানে আমি অনেক তথ্যই দিয়েছি পড়ে দেখতে পারো। প্রকৃতপক্ষে, বিষয়টি খুবই জটিল। কোরিয়ান, চীনারা বলছে জাপানি সেনারা গণহত্যা সংঘটিত করেছে মাঞ্চুরিয়াতে, জাপানিরা বলছে, এটা ছিল যুদ্ধ---যুদ্ধে মানুষ মারা যায় এটাই সত্যি। কিন্তু নাৎসিদের মতো বর্বর গণহত্যা আদৌ ঘটানো হয়নি সেই প্রমাণাদি নেই। চীনারা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মৃতের সংখ্যা এখনো বাড়িয়েই চলেছে। এই নিয়ে সমাধানকল্পে তিন দেশের মধ্যেই আলোচনা হয়েছে অনেকবার সমাধান হয়নি, ভবিষ্যতেও আলোচনা হবে বা যুদ্ধই বেঁধে যেতে পারে অস্বাভাবিক কিছু নয়--কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না।

সমাধান হোক বা না হোক এটা আমার বিষয় নয়, আমি বিষয়টাকে দেখছি এভাবে- জাপানি পক্ষ অপরাধের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এশিয়ার দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাচ্ছে, নানাবিধ উন্নয়নকল্পে ওডিএসহ বিবিধ আর্থিক, প্রযুক্তিগত সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। চীন ও কোরিয়াকে ধনী বানিয়েছে জাপানই এটা কোরিয়ান ও চীনাদের বহু লোক স্বীকার করে কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকরা তা স্বীকার করে না বরং যুদ্ধ ও হত্যাকে ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে দ্বৈত সুবিধা নিচ্ছে। এক. সত্য-মিথ্যা-মিথ তৈরি করে জনগণকে জাপানের পেছনে লাগিয়ে রেখে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখছে। আর দুই হচ্ছে, কিছুদিন পর পর জাপানকে দোষী করে বিক্ষোভ প্রকাশ করে জাপান সেটা থামাতে টাকা ছাড়ে। এইসব এখন ডালভাতের ব্যাপার হয়ে গেছে। মানুষ আর মাথা ঘামায় না।

কিন্তু আমার কাছে জাপানের অনুধাবনটা মহান বলে মনে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বহু দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাপানও কি কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে! টোকিও ছাই হয়ে গিয়েছিল মার্কিনী চিরুনী বোমার আঘাতে! হিরোশিমা-নাগাসাকি আণবিক বোমায় ধুলিস্যাৎ হয়েছে! ওকিনাওয়া যুদ্ধে বিপুল জনক্ষয় হয়েছে। ভারতের ইম্পলে ৫০ হাজারের বেশি জাপানি সেনা মৃত্যুবরণ করেছে। স্টালিনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে শতশত জাপানি যুদ্ধবন্দি। শত শত জাপানি তরুণী ও নারী যৌনক্ষুধার শিকার হয়েছে মার্র্কিনী সেনাদের। মার্কিন সেনা কি কম লোক হত্যা করেছে ফিলিপিন্সে? দুঃখের বিষয় হচ্ছে জাপান ছাড়া অন্য কোনো দেশ শিক্ষালাভ করেনি! কোরিয়াও না, চীনও না। আমেরিকা, রাশিয়া, বৃটেন তো নয়ই! দক্ষিণ কোরিয়ার সেনারা মার্কিন সেনাদের সাথে ভিয়েতনামে সাধারণ মানুষ হত্যা করেছে বলে প্রমাণ হাজির করেছে জাপানি প্রভাবশালী পত্রিকা দৈনিক সানকেইশিম্বুন। চীনা সৈন্য চীন-জাপান যুদ্ধের সময় চীনে বসবাসরত নিরীহ ২০০র বেশি বেসামরিক জাপানিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে--একে বলা হচ্ছে ‘ৎসুশুউ জিকেন’ বা ‘ৎসুশুউ ঘটনা’। চীন দক্ষিণ মঙ্গোলিয়া দখল করে আছে, ভিয়েতনামের কিছু অংশ দখল করে শাসন চালাচ্ছে। থাইল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে চলেছে।

সবচে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, শান্তিপ্রিয় তিব্বত দখল করে সেখানে নিরপরাধ মানুষ মেরে চলেছে। তা হলে জাপানের কৃতকর্মকে বড় করে দেখছে কেন এই দুটি দেশ? কারণটা হচ্ছে, টাকা আদায়। জাপানের টাকা আছে। কিন্তু জাপান তো ধনী হয়েছে যুদ্ধ করে নয়, মেধাবুদ্ধি খাটিয়ে, অমানুষিক পরিশ্রম করে এটা এরা বুঝতে চায় না কেন? জাপান যদি কোটি কোটি ইয়েন ইনভেস্ট না করতো তা হলে চীন কি আজ এই অবস্থায় আসতে পারতো? সবই তো জাপানি প্রযুক্তি যার বদৌলতে চীন উঠে দাঁড়িয়েছে। এই অবদানটা স্বীকার করে না কেন? স্বনামধন্য তাইওয়ানি ইতিহাস গবেষক একাধিক গ্রন্থ লিখেছেন গভীর বিশ্লেষণ করে--তাঁর সুস্পষ্ট ভাষ্য, আধুনিক কোরিয়া ও চীন গড়ে তুলেছে জাপানই।

আদতেই জাপান শান্তিপ্রিয় দেশ ছিল আমেরিকা তার স্বার্থে তাকে সাম্রাজ্যবাদী করেছে এটা্ও আজ দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট। প্রচুর গ্রন্থ এখন লিখিত হচ্ছে এইসব বিষয়াদি নিয়ে। না পড়লে তো ইতিহাস জানা যাবে না।

ইতিহাস পড়ে, গবেষণা করে তোমাকে বির্তকের মূল কারণ জানতে হবে। আমি সেটাই জানার চেষ্টা করছি। আমি কারো পক্ষেও নেই, বিপক্ষেও নেই। আমি সত্য ঘটনা উদঘাটনের পক্ষে।

টোকিও ট্রাইব্যুনালখ্যাত বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের একটি স্মারক ভাস্কর্য এই মন্দিরের প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে। এই নিয়ে এখনো বিতর্ক চোখে পড়েনি। কেন বিতর্ক হবে? তিনি টোকিও ট্রাইব্যুনালকে ৭০০ পৃষ্ঠার অধিক লিখিত রায়ে নাকচ করে দিয়েছেন। মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থার যিনি জাপান হেরে যাওয়ার পর টোকিওতে বসে ১৯৪৫ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত শাসন করেছেন তিনি নিজেই মার্কিন কংগ্রেসে আহুত হয়ে স্বীকার করে গেছেন: টোকিও ট্রাইব্যুনাল ছিল একটি ভুল বিচার। তা হলে তো ঠিকই আছে। বিচারপতি পাল প্রথম থেকেই এই বিচারকে অস্বীকার করে আসছিলেন, সাজানো প্রহসন বলছিলেন। আইনের যৌক্তিক তুবড়ি মেরে আমেরিকার মুখ ভোঁতা করে দিয়েছেন! এই জন্য মার্কিনীরা বাঙালিকে ভয় পায়। নেতাজিকে, বঙ্গবন্ধুকে ভয় পেতো।

সুতরাং, বীর বাঙালি বিচারপতি পালের স্মারক ভাস্কর্যের সামনে একটা স্মারক ছবি তুলে দিলাম তোমাকে তুমি নিঃসন্দেহে গর্ব করতে পারো। মনে রাখবে পাঁচ জন বীর বাঙালি এই পৃথিবীকে খেলা দেখিয়েছেন এঁরা হলেন, এশিয়ায় প্রথম নোবেল জয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল এবং বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি ছিলেন পূর্বজদেরই যথার্থ উত্তরাধিকারী।

কাহিনী শেষ। জাপানে ছিলে ১২ বছর মানে এক যুগ। টোকিওকেই ঠিকমতো দেখতে পারোনি। সারা জাপানের কথা বাদ দিলাম। এই বিশাল রাজধানী টোকিও বাঙালির উষ্ণমধুর স্মৃতিতেও ধন্য হয়ে আছে। দুর্ভাগ্য যে এই ইতিহাস লেখা হয়নি। পড়ানোও হয় না। বাঙালিও জানে না।

লেখক : জাপান প্রবাসী ও গবেষক