শরীয়তপুর প্রতিনিধি : পদ্মা সেতুর সেনানীবাস প্রকল্প এরাকায় অধিগ্রহনকৃত জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও ভূয়া গাছ পালা লাগিয়ে কোটি কোটি হাতিয়ে নিচ্ছিল স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট। এলাকার এক সচেতন ব্যক্তির আবেদন ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর পুন:তদন্তে ১৫ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে। আর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শরীয়তপুরের জেলা প্রশসাক।

সরকারের এ কোটি কোটি টাকা সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা করতে জেলা প্রশাসনের কাছে তদন্তের আবেদন করায় মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতার মুখে পরেছে আবেদনকারি কালাম খান ও তার পরিবার। সিন্ডিকেট সদস্যদের ভয়ে গত এক মাসেরও বেশী সময় ধরে বাড়ি ছেরে জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আবুল কালাম খান।

পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানকল্পে ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড এর স্থায়ী সেনানীবাস নির্মানের জন্য পদ্মা সেতু এলাকার জাজিরা পয়েন্টে একটি স্থায়ী সেনানীবাস নির্মাণ করা হবে। এ জন্য পদ্মা সেতুর জাজিরা অংশের ল্যান্ডিং পয়েন্টের পূর্ব পাশে ১০১ নং নাওডোবা মৌজায় এল এ ৮ নং কেস এর মাধ্যমে প্রায় ১ শত একর ভূমি অধিগ্রহন করা হয়। অধিগ্রহনকৃত ভূমিতে শত শত অবৈধ ঘর নির্মাণ, গাছপালা লাগানো ও পুকুর খনন করে স্থানীয় একটি চক্র। তারা নামে বেনামে, জমির মালিক না এমন ব্যক্তির নাম দেখিয়ে, দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে এমন আত্মীয় স্বজনদের নামে ঘর তোলেন এবং গাছ পালা রোপন করেন। এতে জেলা গণপূর্ত বিভাগ ৩৬৩ জনের নামে ঘর বাড়ি অবকাঠামো দেখিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য তালিকা প্রস্তুত করেন। আর বন বিভাগ ১৮৫ জনের নামে গাছ পালার তালিকা প্রনয়ন করে সেখান থেকে প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। তাতে দুই তালিকায় প্রায় ৬১ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

সরকারের এই কোটি কোটি টাকা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি জানতে পেরে গত ১৮ জানুয়ারি স্থানীয় মৃত সরল খানের কনিষ্ট পূত্র আবুল কালাম খান বিষয়টি তদন্ত পূর্বক ক্ষতিপূরণের ন্যায্য টাকা পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে শরীয়তপুরের জেলা প্রশসাক বরাবরে একটি আবেদন করেন। এই আবেদনের সূত্র ধরে শরীয়তপুরের গণমাধ্যম কর্মীরা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর জেলা প্রশাসক গণপূর্ত বিভাগ ও বন বিভাগকেই পুন:তদন্তের দায়িত্ব অর্পন করেন। ৩৬৩ ব্যক্তির নামে ঘর বাড়ি ও অবকাঠামোর ক্ষতিপূরণের চুড়ান্ত মূল্যায়ন ও প্রতিবেদন যে কর্মকর্তা প্রস্তুত করেছিলেন, গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সেই এ,এস,এম শাহরিয়ারের মাধ্যমেই গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ৩৬৩ জনের অন্তত এক হাজার স্থাপনার পূন:তদন্ত করানো হয় মাত্র ২ ঘন্টায়। সেখানে এক তরফা নামকাওয়াস্ত তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ার কথা জানানো হয়।

অপর দিকে ফরিদপুর বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে জেলা প্রশাসক গাছ পালার পুন:তদন্তের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারী থেকে ফরিদপুর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বন বিভাগের ৫ জন লোক ১৫ দিন সময় ধরে তদন্ত করেছেন বলে জানা গেছে। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে গাছ পালার ক্ষতিপূরনরে নামে মূল্য নির্ধারনে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি ও অনিয়ম সংগঠিত হয়েছিল। শরীয়তেপুর জেলার ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা সুধীর চন্দ্র রায় দেবসিংহ সিন্ডিকেট সদস্যদের সাথে আতাত করে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ফাঁদ পাতে। তিনি ১৮৫ ব্যক্তির নামে ২৬ কোটি ৪৮ লক্ষ ৮ হাজার ৩৬০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করে তালিকা জমা দেন। পূন:তদন্তকারি দল তাদের তদন্তকালে সেখানে ১১ কোটি ১৮ লক্ষ ২১ হাজার ১০০ টাকার গাছ পালার অস্তিত্ব খুঁজে পান। এতে করে ১৫ কোটি ২৯ লক্ষ ৮৭ হাজার ২৫০ টাকার দুর্নীতি প্রমাণিত হয়।

এদিকে দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে শরীয়তপুরে কর্মরত সংবাদ কর্মীদের উপর দফায় দফায় হামলা, আক্রমন ও মিথ্যা মামলা দিতে থাকে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ১৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় ৪ জন তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেত গিয়ে সিন্ডিকেটের ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দ্বারা হামলার শিকার হন। সেদিন সাংবাদিকদের ব্যবহৃত দুইটি মোটর সাইকেল সিন্ডিকেটের ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা ভাংচুর করে। ২৭ ফেব্রুয়ারি তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে পুনরায় সিন্ডিকেট সদস্যরা দৈনিক প্রথম আলো, যমুনা টেলিভিশন, ইন্ডিপিন্ডেন্ট টেলিভিশন এর শরীয়তপুর প্রতিনিধিসহ একজন স্থানীয় সাংবাদিককে মারধর করে তাদের ক্যামেরা, ব্যুম, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। এঘটনায় যমুনা টিভি প্রতিনিধি জাজিরা থানায় একটি মামলা দায়ের করলে ২৮ ফেব্রুয়ারী শরীয়তপুর চীফ জুডিসিয়াল মেজিস্ট্রেট আদালতে সিন্ডিকেট সদস্যরা এক নারীকে দিয়ে চারজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে পাল্টা চাদাবাজি ও নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ১০ থেকে ১৫ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে এই প্রকল্প ঘিরে। তারা হলেন, শরীয়তপুর জজ কোর্টের এপিপিএ্যাডভোকেট আলমগীর হোসেন হাওলাদার, মতিউর রহমান চন্নু ঢালী, ছাত্তার মিয়া ঢালী, নুর মোহাম্মদ ঢালী, গোলাম মুর্তজা ফারুখ ঢালী, আবুল কালাম আজাদ রুবেল ঢালী, হিরণ ঢালী, দাদন ঢালী, দেলোয়ার ঢালী, লালমিয়া মোলঙ্গী, বাবুল হাওলাদার, হাফিজদ্দিন ফরাজী প্রমুখ।

শরীয়তপুরের স্থানীয় সাংবাদিক মো. বেলাল হোসেন বলেন, ১৩ ফেব্রুয়ারি আমরা তদন্ত কাজের তথ্য সংগ্রহ করলে সেখানে সিন্ডিকেটের লোকেরা আমাদের উপর হামলা করে। আমাদের দুইটি মোটর বাইক ভাংচুর করে। যমুনা টিভি শরীয়তপুর প্রতিনিধি কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, ২৭ ফেব্রুয়ারী সংবাদ সংগহ করতে গিয়ে আমরা ৪ জন সাংবাদিক সিন্ডিকেট সদস্যদের হামলার শিকার হই। আমাদের পেশাগত কাজে বাধা সৃষ্টি করে ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, ব্যুম ছিনিয়ে নেয়। উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনকারি আবুল কালাম খান মুঠোফোনে বলেন, সিন্ডিকেট সদস্যরা গণপূর্ত বিভাগ, বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় অবৈধভাবে সরকারের কোটি কোটি আত্মসাতের পরিকল্পনার বিষয়টি জানতে পেরে আমি জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন করি। এর অনুলিপি আমি শরীয়তপুরের গণমাধ্যমের কর্মীদের কাছে পাঠাই। সাংবাদিকেরা সংবাদ প্রকাশের পর পূন:তদন্ত কারানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ঘর বাড়ি, অবকাঠামোর কোন তদন্ত না করেই প্রায় ৩৫ কোটি টাকার বিল প্রদান শুরু করেছে। আর গাছপালার পুন:তদন্ত সঠিকভাবে করা হলে প্রকল্প এলাকায় এক কোটি টাকার গাছও পাওয়া যাবেনা। তার পরেও সরকারের ১৫ কোটি টাকা বাচাতে পেরে আমি আনন্দিত। কিন্তু আমি আজ একমাস যাবৎ সিন্ডিকেট সন্ত্রাসীদের ভয়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে বেরাচ্ছি। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছি ঘরবাড়ি, অবকাঠামোর পূন: তদন্ত করা হলে সরকারের অন্তত আরো অন্তত ২০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। আমি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও সিন্ডিকেট সদস্যদের যথাযথ শাস্তি দাবি করছি।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, এক ব্যক্তি আমার কাছে একটি আবেদন করেছেন। আমি বিষয়টি গণপূর্ত বিভাগ ও বন বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পুন:তদন্তের জন্য হস্তান্তর করেছিলাম। গণপূর্ত বিভাগ তাদের তদন্তে আবেদনকারির অভিযোগের কোন সত্যতা পায়নি। তবে বন বিভাগের অনিয়মের অভিযোগ সঠিক ছিল এবং সেখান থেকে প্রায় ১৫ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার অনিয়ম প্রমানিত হয়েছে।

(কেএনআই/এএস/মার্চ ১৭, ২০১৭)