ভবেরপাড়ার মুক্তিযুদ্ধ

ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগরের পূর্বনাম) এলাকার আশেপাশের গ্রাম --বৈদ্যনাথ তলা, মোনাখালি, নাটুদাহ, রশিকপুর, মহাজনপুরে পাকিস্তান বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। তারা সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করতো, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত। ইতঃমধ্যে ভৈরব নদীতে গ্রামবাসীরা শত শত মানুষের মৃতদেহ ভেসে যেতে দেখেছে। তাই তারা খুব আতঙ্কে দিনযাপন করছিল। তারা প্রাণের ভয়ে অস্থির ছিল। হানাদার বাহিনীর দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার জন্য মুক্তিবাহিনীরা সংগঠিত হতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণের পর অনেকেই প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যায়। আর কিছু যুবক গ্রামে থেকে যায়। তারা মা-বোনদের রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল।

১৯৭১ সালের ১৮ই এপ্রিল শিবপুর গ্রামের মহসিল আলী ১০/১২ জন যুবককে নিয়ে একটি আমবাগানে বসে বৈঠক করে। পাকসেনাদের কীভাবে ঘায়েল করা যায় সে সম্পর্কে তারা আলোচনা করতে থাকে। এমন সময় পাকবাহিনীর একটি বিমান আকাশের উপর দিয়ে চক্কর দিয়ে চলে যায়। তৎকালীন মেহেরপুর জেলার প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলোচনায় বসে এবং তিনি তাদেরকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। নদীয়া জেলার ডিসি সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবেন বলে তাদেরকে আশ্বস্ত করেন। যেভাবেই হোক পাকিস্তান বাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। পরবর্তীতে কিশোর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বেতাই যুব শিবির ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হয়।

পাকসেনারা বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে আক্রমণ করে গুরুতর আহত করে। আহত মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। তাদের চিকিৎসার জন্য ভল্লবপুর হাসপাতাল হতে কিছু ঔষধপত্র নিয়ে কয়েকজন যুবক বাড়িতে ফিরছিল। কিছুদূর যেতেই তারা দেখে পাক সৈন্যরা একটি জীব গাড়ি নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। যুবকরা তাৎক্ষণিকভাবে মাঠের মধ্যে অবস্থান নেয়। পাকসৈন্যরা তাদেরকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। যুবকরাও পাকসেনাদের লক্ষ করে পাল্টা গুলি ছোড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া গুলিতে জীব গাড়ির চাকা ব্রাস্ট হয়ে যায়। এর ফলে কয়েকজন পাকসৈন্য নিহত হয়। পরেরদিন পাকবাহিনীর সদস্যরা মানিকনগর সীমান্তের নিকটে ৩৩ ফোর্সের একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রায় প্রতিরাতে তারা রাজাকারের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে আক্রমণ করতো। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত। তাদের হাত থেকে স্ত্রী ও মায়েরাও রক্ষা পেত না। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা মানিকনগর ঘাঁটি আক্রমণ করার একটি পরিকল্পনা করে। একমাস যেতে না যেতেই মুক্তিবাহিনী গভীররাতে মানিকনগর ঘাঁটি আক্রমণ করে সেটিকে ধ্বংশ করে ফেলে। এতে অনেক পাকসেনা নিহত হয়।

ভবেরপাড়া একালায় অবস্থিত পাকিস্তানের ঘাঁটিগুলো ধ্বংশ করার জন্য মুক্তিবাহিনীরা সংগঠিত হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে তারা পিছু হটবে বাধ্য হয়। এরপর তারা মোনাখালি ঘাঁটি আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। শিবপুরের মহসিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ভৈরব নদীর পাড় ধরে দারিয়াপুরের নিকটে অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা ছিলেন তারা হলেন-দারিয়াপুরের নজরুল, মেহেরপুরের সুনীল, কার্পাসডাঙ্গার লুৎফর, যতারপুরের আলাউদ্দিন, বরকত, আ. হামিদ, রবিউল, করিম, জসিম, আলীসহ নাম না জানা অনেক ইপিআর, মুজাহিদ ও আনসার সদস্য। আক্রমণের পরিকল্পনাটি রাজাকার ছামাদের মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনী আগেই টের পেয়ে যায়। ঠিক একদিন পরেই পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। প্রায় ০৪দিন ধরে সংঘর্ষ চলতে থাকে। ওই যুদ্ধে পাকিস্তান ক্যাম্পের অধিনায়ক জসিম উদ্দিন খাঁ ও কয়েকজন পাকসেনা ব্যতীত রাজাকার ছামাদসহ সকলেই সৈন্য নিহত হয়।

রশিকপুর ঘাঁটিতে পাকিস্তান বাহিনীর প্রায় ৯৯ জন সৈন্য ছিল। ওই ঘাঁটি আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে অধিনায়ক সুবেদার রাহেল উদ্দিন খাঁন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সীমান্ত থেকে কতগুলো সেল নিয়ে আসে। দুর্ভাগ্যবসত কয়েকটি সেল পানিতে পড়ে যায় আর ঘাঁটির অদূরে দুটি সেল রশিকপুর মাঠের মধ্যে পড়ে থাকে। বাকী সেলগুলো মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। পড়ে থাকা সেল দুটি অসতর্কভাবে বিস্ফোরণ হলে শিবপুর গ্রামের মোসলেম গুরুতর আহত হন। এদিকে পাকসেনারাও সতর্ক হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা যেকোন সময় ক্যাম্প আক্রমণ করতে পারে এই ভয়ে পাকসেনারা ক্যাম্পটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ২৮শে অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে বেশকিছু পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। একপর্যায়ে পাকসেনারা রশিকপুর ঘাঁটি ছেড়ে নাটুদাহ হেডকোয়ার্টারে পালিয়ে যায়।

ভবেরপাড়ার অধিকাংশ এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। বাকী থাকে নাটুদাহ হেডকোয়ার্টার। পাকবাহিনীকে শায়েস্তা করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করে। তারা গোপনে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে যে, নাটুদাহ হাইস্কুলের আশে পাশের বিভিন্ন বাঙ্কারে প্রায় ৮/৯ হাজার পাকসেনা অবস্থান নিয়েছে। রাতের আঁধারে মুক্তিবাহিনীরা বেদে সম্প্রদায়ের সহায়তায় শত শত সাপ বাঙ্কারগুলোতে ছেড়ে দেয়। দুই একদিনের মধ্যে শত শত পাকসেনা সাপের দংশনে নিহত হয়। এতে পাকসেনারা প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়। কোন উপায় না পেয়ে শেষপর্যন্ত পাকসেনারা নাটুদাহ ক্যাম্প ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর ফলে ভবেপাড়া এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। ভবেরপাড়া এলাকা শত্রু মুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন গ্রামবাসীদের মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।