সুপ্রিয় সিকদার : আমি ছবি আঁকতে খুব পছন্দ করি। আমার আছে একটি ক্যানভাস, ছোট বড় সাইজের চারটি রঙ তুলি আর আছে মাত্র চারটি রঙ; লাল, নীল, সবুজ আর কালো।

রং আর তুলি দুই বন্ধু। দুজনের খুব মিল। একই মেঝেতে ওদের বসবাস। সারা দিন একসঙ্গে খেলা করে। মাখামাখি করে। তবুও রঙের মনে খুব দুঃখ। তুলিটা কত সুন্দর চলাফেরা করতে পারে। যেখানে মন চায়, যেতে পারে। কিন্তু রং সারা দিন চুপচাপ বসে থাকে। ছোটমতো একটা কৌটায় নীরব বসে থাকতে রঙের ভালো লাগে না। একটু বের হওয়া যায় না। বের হলেই ঘটে যায় অঘটন।

রং আর তুলি মিলেমিশে একাকার। সাদা ক্যানভাসে আকাআকি করে। রং আর তুলি মিলে ছবি আঁকে। কত সুন্দর সেই ছবিগুলো! রঙের খেলায় কী চমৎকার হয়ে ফুটে ওঠে এক একটা ছবি। নীল আকাশ; আকাশে সাদা সাদা মেঘ।

রং ইদানীং খুব ভাব নিয়ে থাকে। আগের মতো আর তুলিকে তেমন পাত্তা দেয় না। তুলির সঙ্গে গল্প করে না। একসঙ্গে মাখামাখি করে না। তুলি রঙের এমন ব্যবহারে কষ্ট পায়। তার পরও নিজেকে সে ছোট ভাবে না। সে জানে, তুলি দিয়েই তো রঙের খেলা খেলতে হয়। তুলি ঘুরিয়েই রঙের আলপনা আঁকতে হয়। ক্যানভাসে ছবি আঁকতে তুলির ভূমিকা রঙের চেয়ে কম নয়।

মানিয়ে নেবার পরও একদিন সত্যি সত্যি রাগ হয় তুলির। রঙের সঙ্গে আড়ি দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।

রঙ একটা পর্যায়ে তাঁর ভুল বুঝতে পারে। তুলির কাছে ক্ষমা চায়। বলে, তুলি! আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি না বুঝে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। আসলে তুমিও অনেক কাজ কর।

রং আর তুলি আবার এক হয়ে যায়। দুজনে একসঙ্গে লাফিয়ে ওঠে। তারপর ক্যানভাসে খেলা শুরু করে। রং আর তুলির মাখামাখিতে সুন্দর সব ছবি ফুটে ওঠে।

এখানে, এই তুলি আমার নিজের মন আর রঙ আমার বিবেক। এই রঙ আর তুলির মন খারাপের সময়টা আমার জীবনের দ্বন্দ্ব আর তাদের মিলন আমার জীবনের সুখ।

আমি ছবি আঁকি, মন খারাপের ছবি আঁকি, মন ভালো করার ছবি আঁকি, আঁকি বসন্তের ছবি, আঁকি ভালোবাসার ছবি।

লাল রঙের ব্যবহার খুব বেশি আমার ক্যনভাসে। আমি যখন কষ্ট পাই, কারো কষ্ট দেখি, তখন কেন জানি লাল রঙের ব্যবহার খুব বেড়ে যায় আমার ক্যানভাস। যখন প্রশ্নফাস, শিক্ষাকে বাণিজ্যকরণ, সার্বজনীন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে লাখ টাকার আতশবাজি ফোটে আর সেই একই অনুষ্ঠানে গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে ভিক্ষা করে একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, আমি নিজেকে আবিস্কার করি কোন ভুল পথে, কোন অন্যায়ে, যখন কোন অপরাধের প্রতিবাদ করতে পারি না, অনিচ্ছা সত্বেও সহ্য করতে হয় কোন অন্যায় তখন কেন জানি আপনা আপনি লাল রঙ দিয়ে ছবি আঁকি আমার ক্যানভাসে। লাল এখানে নিষিদ্ধ রঙের মতোন মনে গেথে গিয়েছে আমার, যেমনটা রাস্তায় লাল রঙে চলাচল নিষিদ্ধ হয় গাড়ির।

যখন সমাজের অবক্ষয়, ফেলানির ঝুলন্ত লাশ, পেট্রোল বোমায় আহত হওয়া হাজারো মানুষের আর্তনাদ, ২১শে আগস্টের নির্মম বোমা হামলা, উদীচীর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বর্বর বোমা হামলা, আমার বোন তনুর হত্যা, গুলশানের হলি আরটিসানে নারকীয় হামলা, শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজে হামলা, দীর্ঘ বিচারহীনতা দেখি, তখন আমার ক্যানভাসের রঙ কেন যেন কালো হয়ে যায়। যাই আঁকি তাই কেমন কালো হয়। অন্ধকার চারপাশে আলো খুঁজে ফিরি, কখন শেষ হবে এই ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার, ভাবতে থাকি আর ভাবতেই থাকি।

যখন আমার দেশ ক্রিকেট খেলায় শততম টেস্ট ম্যাচ জয় করে, আমার দেশ অর্জন করে সমুদ্রসীমা, নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় নতুন সাবমেরিন, নিজস্ব অর্থায়নে হয় পদ্মা সেতু, নাগরিক হিসেবে আমি পাই স্মার্ট কার্ড, যখন আমার দেশের সোনার ছেলে মেয়েরা হিমালয় চুড়া জয় করে, যখন আমার দেশের পুলিশ বা আর্মি যায় জাতিসংঘ শান্তি মিশনে, যখন আমার দেশের উন্নয়ের চাকা ঘুরে যায় সামনের দিকে তখন আমার ক্যনভাসের রঙ পাল্টে যায়, আপনা আপনিতেই রঙটি হয়ে যায় সবুজ। মনের ভেতরের সকল অস্থিরতা ভেঙ্গে কেমন এক শান্ত আর শান্তির আবহাওয়া বয়ে যায়।

যখন প্রিয়জনের মুখে অমুল্যবান হাসি দেখি, বাবা-মা-ভাইকে হাসতে দেখি, আমার নিজের অবস্থানে নিজেকে সঠিক মনে হয়, মনে হয় না আমি এমন কিছু করছি যা আমার অস্তিত্বকে জানান দেয়, আমি এমন কিছু করছি যা শুধু আমার নয় আমাদের, আমাদের সমাজের তখন আমার ক্যানভাসের রঙ পাল্টে নীল হয়ে যায়। নীল আমার প্রিয় রঙ, হয়তো ভালোবাসার মানুষগুলোর অবস্থান আমার এই রঙে আছে বলেই ভালোবাসি এই রঙটিকে।

এভাবেই আমি রঙ আর তুলির সাহায্যে আমি আমার ক্যানভাসে বিভিন্ন অবস্থা, বিভিন্ন সময় আর বিভন্ন ক্ষণের ছবি আঁকি। আমার কাছে এই ছবিগুলোই জীবন আর জীবন মানেই একটি ক্যানভাস। আমি বড় হই সাথে সাথে বড় হয় আমার ছবি আকার ক্যানভাস আর বাড়তে থাকে আমার চারটি রঙের ব্যবহার। ক্যানভাসে কখনও থাকে লালের প্রাধান্য, কখনও সবুজ, কখনও নীল কখনও বা কালো...

এটাই আমার জীবন আর আমার কাছে জীবন একটি ক্যানভাস যা জীবনের সাথে সাথেও আকারে আয়তনে বাড়তেই থাকে...

আমার কাছে জীবন মানে একটি ক্যানভাস, একটি ক্যানভাস এবং একটি ক্যানভাস।

(এসএস/অ/মার্চ ২১, ২০১৭)