মাসকাওয়াথ আহসান : শুল্ক গোয়েন্দারা ‘গুলশানে’ প্রিন্স মুসার বাড়িতে একটি কালো গাড়ি দেখে সন্দেহ করে; এটা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কেনা গাড়ি। গাড়িটি কালো হলেও ভোলায় করা নিবন্ধনে গাড়িটির রঙ সাদা লেখা রয়েছে। ভোলায় নিবন্ধন বলে সবাই গাড়িটির রঙ ভুলে যাবে এমনটাই প্রত্যাশা করেছিলেন প্রিন্স মুসা। কিন্তু গোয়েন্দারা প্রথমে সিসিটিভিতে শনাক্ত করে এরপর প্রিন্সের প্রাসাদ তল্লাশি করে গাড়িটিকে চিহ্নিত করে। প্রিন্স বলে তাকে গাড়িটি ভদ্রলোকের মত জমা দিতে অনুরোধ জানানো হয়।

কিন্তু প্রিন্স আরেকটু বাঘ-বকরি খেলতে চান সাদাকালো ছকে। গাড়িটি জমা না দিয়ে তাতে করে নাতিকে গুলশান থেকে ধানমণ্ডির সানবিম স্কুলে পাঠিয়ে দেন। নাতিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে কালো গাড়ি চলে যায় ধানমণ্ডির লেকব্রিজ প্রাসাদে। নাতিকে আরেকটি সাদা গাড়িতে করে স্কুল থেকে গুলশানের প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে লেকব্রিজ প্রাসাদে পেয়ে যায় ‘সর্বোনেশে’ কালো গাড়িটি। গাড়িটি জব্দ করা হয়।

লোকজন মিডিয়ায় খবরটি পেয়ে বিস্মিত হয় গোয়েন্দাদের সাহস দেখে। অনেকে আশংকা প্রকাশ করে, বেয়াইয়ের গাড়িতে হাত দিয়েছে; ও হাত কী থাকবে!

এ আশংকার কারণও আছে; প্রিন্স মুসার বিরুদ্ধে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী ঘাতক সেনাবাহিনীর দেশীয় সহযোগী হিসেবে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করায় জনকন্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের একটি পা খেয়ে নিয়েছিলো সংক্ষুব্ধ পক্ষ।

অথচ এ দাবি কেবল প্রবীর সিকদারের একার নয়। মুসার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের আত্মীয়তার সম্পর্কই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত আটকে রেখেছে বলে মনে করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম আবু ইউসুফ সিদ্দিকী পাখী। ফরিদপুরের রথখোলার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা বাবুনাথও বলছেন, তিনিও মুসার ‘যুদ্ধাপরাধের’ সাক্ষী।

‘মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর’ বইয়ের লেখক, সাংবাদিক আবু সাঈদ খানও একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালতের তদন্ত কর্মকর্তারা যথেষ্ট এভিডেন্স নেই বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন এতোজন মানুষের দাবি। ফরিদপুরের সার্কিট হাউজে পাকিস্তানের ঘাতক সেনা কর্মকর্তা মেজর আকরাম কোরাইশির সঙ্গে মুসার ঘনিষ্টতা সচক্ষে দেখেছেন মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ সিদ্দিকী পাখী। তিনি অভিযোগ করেন, এই নুলা মুসা আমার মামাত ভাইকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো।

মুসাকে পাকিস্তানি সেনা টর্চার সেলের দিকে ঘন ঘন যাতায়াত করতে দেখা গেছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মাসুদ হোসেনও বলেন, তদন্ত বা বিচারের প্রয়োজনে সাক্ষ্য দিতে তিনিও ‘প্রস্তুত’।

তদন্ত কর্মকর্তা নিজেও শুনেছেন, মুসা কৌশলে এক নারীকে তুলে দিয়েছিলো পাকিস্তানী ঘাতক সেনাদের হাতে। কিন্তু সাফিশিয়েন্ট এভিডেন্স নেই বলে তিনি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন।

প্রিন্স মুসার সঙ্গে দেশের কোন মিডিয়ার সাংবাদিক দেখা করতে পারে না। প্রত্যেকদিনই তার শরীর খারাপের অজুহাত থাকে। শুধু তার শরীর ভালো হয়ে ওঠে কোন বিদেশী সাংবাদিক তার রাজসিক জীবন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে এলে।

গাড়ি জব্দ হবার সূত্র ধরে তার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আবারো মিডিয়ায় আসায় খুব বিরক্ত হন প্রিন্স মুসা। উনি বলেন, কেউ কী আমাকে নিয়ে তৈরি করা ডকুমেন্টারি দেখেনি; আমাকে আমার মুখে ভাত তুলে না দিলে আমি তো খেতেই পারিনা; আমি যুদ্ধাপরাধ করবো কীভাবে!

প্রিন্স মুসার ছেলে ববি হাজ্জাজ মিডিয়ার সামনে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন।

বেয়াইনগরের লোকেরা ভাবে, বেয়াইয়ের ভিত্তি যেখানে এতো মজবুত; তখন ‘যুদ্ধাপরাধে’-র অভিযোগ ভিত্তিহীন হয়ে পড়া স্বাভাবিক।

লোকজন পত্রিকায় গাড়ি জব্দের খবর পড়তে পড়তে মন্তব্য করে, ‘সিসিটিভি তে গাড়িটা ধরা না পড়লে এই শুল্ক ফাঁকি দেয়া গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগটিও ভিত্তিহীন হয়ে যেতো।’

লেখক : জার্মানি প্রবাসী সাংবাদিক।
(ওএস/এএস/মার্চ ২২, ২০১৭)