প্রবীর বিকাশ সরকার


১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতের অভিজ্ঞতা আমার। তখন ১২ বছরের কিশোর। এটা চিটাগাং গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডে কুমিল্লা ফৌজদারি কোর্টের কাছে অবস্থিত পুলিশ ফাঁড়ি জেলহাজতের দেয়ালঘেঁষা। এই সামনে দিয়েই যেতে হয় পুলিশ লাইনের দিকে। তখনকার আমাদের বাসা ছিল ফাঁড়ির পেছনে ছোটরা’র পাইক পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণে। ফাঁড়িটি পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত তাই বাসা থেকে ফাঁড়ির ওপর দিয়ে যা দেখেছিলাম-

২৫ তারিখ মধ্যরাতে বিকট রকম দ্রাম, দ্রুম, ঠাস ঠাস, টা টা টা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল সবার। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম বিছানায়। কোথা থেকে এই শব্দ আসছে সহসা বুঝতে পারলাম না ঘুমের ঘোরে। রাতের বাতাসে একটু হিম। আধখোলা জানালা দিয়ে দেখলাম পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের আকাশ ভীষণ লাল! ক্ষণে ক্ষণে হলদে আর কমলা রঙের আগুন কুণ্ডুলি পাকিয়ে উঠছে উপরের দিকে শব্দ করে আবার নিভে যাচ্ছে। পুরো শহরই মিসমিসে কালো অন্ধকার। অনবরত শব্দ করে বোমা না কি যেন ফাটছে আর চারদিক ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। মানুষের হৈহল্লাও অস্পষ্টভাবে ভেসে আসছে। বারুদের তেজস্ক্রিয় খুশখুশে গন্ধ বাতাসে ধেয়ে আসছে এদিকেই। বাবা গায়ে শার্ট চড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আমিও গেলাম বারান্দায়। মাও উঠে এসেছে পেছনে পেছনে। ছোটভাই ও বোন দু’টো গভীর ঘুমে। দেখলাম শিখাদের উঠোনে হরেন জেঠু ও কালীদা দাঁড়িয়ে। বাবা হরেন জেঠুকে বললেন, ‘পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে।’
হরেন জেঠু বললেন, ‘হ্যাঁ। পুলিশ লাইনই হবে। শেষ পর্যন্ত নামলো সামরিক জান্তা!....স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কিন্তু জেলখানা রোড ধরে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে, ছুটছে, দেখুন’!
বাবা বলল, এরা পুলিশই হবে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধই লেগে গেল দেখছি!
কালীদা কালো চাদর গায়ে জড়িয়ে একটা বড় রামদা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল দেখে বাবা বললো, ‘কালী পাগলামি করো না। সকাল পর্যন্ত দ্যাখো কী হয়। অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। সাবধান!’
জেঠু আবার বললেন, ‘কালী বেরোবি না ঘর থেকে। অবস্থা বুঝে সকালের আগেই শহর ছাড়তে হবে।’
এমন সময় কিশোরের বাবা এগিয়ে এলেন, বললেন, ‘সকালের মধ্যেই মিলিটারি ছড়িয়ে পড়বে শহরে। যে যেভাবে পারছে পালাচ্ছে। আপনারাও সরে পড়ুন এখনই। কী হয় বলা যায় না।’
হরেন জেঠু বললেন, ‘কী বলেন বাবু, পরিস্থিতি আমার কাছেও ভালো ঠেকছে না। চলুন আপাতত নদীর ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই।’

কত ঘণ্টা পর্যন্ত চললো প্রচণ্ড গোলাগুলি তা মনে নেই। আমার তখনো বদ্ধমূল ধারণা পুলিশ ছাড়া আর কাউকে মারবে না পাকিস্তানি মিলিটারিরা। মা কখন যে ঘরে চলে গেছে ঘরের ভেতরে জানি না। বাবা বললো, ‘দেখি কী করা যায়। আপনারা গেলে এখনই বেরিয়ে পড়ুন।’

কালীদা তো তখনই বেরিয়ে গেছে। এর পর হরেন জেঠু দরজা লাগিয়ে একটি ঝোলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন অন্ধকারে। তাঁদের চলে যাওয়া দেখে ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করলো আমার। অসহায় হয়ে গেলাম মনে হলো। স্তব্ধ চারদিক। কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। মৃতপুরী যেন শহরটা। বাতাসে পোড়া বারুদের ভীষণ দুর্গন্ধ। ঘরে ফিরে বাবা নিজে নিজেই বললো, ‘পুলিশ তো সরকারি কর্মচারী। পুলিশ লাইন আক্রমণ করলো কেন মিলিটারিরা? তাহলে কী বাঙালি পুলিশকেও মারবে ওরা? বাবা কেবলি ঘরবার করতে লাগলো। মা যদিওবা বরাবরই সাহসী তবুও কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। এভাবে আর না ঘুমিয়ে সকালবেলা মা যথারীতি জলখাবারের ব্যবস্থা করছিল। বাবা রেডিও শুনছিল বৈঠকঘরে। এমন সময় মা হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ‘বাইরে কালো পোশাকপরা লোকজন ঘোরাফেরা করছে! আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে একজনের।’ মার মুখ একেবারে রক্তশূন্য সাদা। মুখটা গত রাত থেকেই শুকিয়ে আছে।

লেখক : জাপান প্রবাসী সাহিত্য গবেষক।