আম্বিয়া অন্তরা


মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো অনেক খানি কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। এসব স্মৃতিগুলো গল্পের মত মনে হয়। আজ আমি আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা স্মৃতিকথা তুলে ধরছি পাঠকের জন্য।

মায়ের মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি পড়ে অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন বিশেষ করে স্বাধীনতার ১০/২০ বছর পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। তারা জানতে চেয়েছে কেন এবং কি কারণে এই মর্মান্তিক যুদ্ধ হয়? তাই আমি আবার বই পড়ে এবং ভাইয়ের কাছে জানা কিছু তথ্য লিখছি। আমাদের বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধের কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈষম্যসহ নানা ধরণের বঞ্চনা ছিল। মোট জাতীয় বাজেটের সিংহ ভাগ বরাদ্দ থাকতো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। পাকিস্তানের মূল শাসক গোষ্ঠী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। পশ্চিমা শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সৎ মায়ের মত আচরণ করত। পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) চরম অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) মানুষ পাকিস্তান সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে এবং মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। আর একটু অতীতে ফিরে যাচ্ছি শুধুই এই প্রজন্মের সন্তানদের জানানোর জন্য।

পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণমূলক আচরণ। কেবল অর্থনৈতিক শোষণ নয়, বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপরও নিপীড়ন শুরু হয়। মাতৃভাষা বাংলা চাই দাবি নিয়ে আন্দোলন হয়। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য রফিক, সালাম, বরকত ও জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। এমন ঘটনা সারা বিশ্বে কোথাও কোনদিন ঘটেনি। ভাষা আন্দেলনের পর শুরু হয় আমাদের জাতির মুক্তির সংগ্রাম। মূলত ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনেই বপিত হয়েছিল স্বাধীনতার বীজ। ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম ‘এক লোক এক ভোট’ এই সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের সমস্ত হিসাব নিকাশ ওলট পালট করে দেয়। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে দুটি আসন বাদে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলীতে সবগুলো আসন পেয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলীর প্রথম বৈঠক। এ অ্যাসেম্বলিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছিল বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। ব্যাপারটা প্রথম থেকেই পাকিস্তানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সেই অ্যাসেম্বলি ১ মার্চ এক রেডিও ভাষণের মধ্য দিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করে দেয় ইয়াহিয়া খান। বাঙালীদের ষড়যন্ত্রটি ধরতে কিন্তু কোন দেরি হয়নি। ইয়াহিয়া খানের রেডিও ভাষণ শেষ হতে না হতেই ঢাকার রাজপথে সেদিন নেমে এসেছিল মানুষের ঢল। মুখে ছিল স্লোগান “ভুট্টোর মুখে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর” ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ইয়াহিয়া তার ভাষণে বলেছিল ভুট্টো ঢাকায় আসতে সম্মত হয়নি বলেই প্রধানত অধিবেশন স্থগিত করা হলো।

সেই শুরু স্বাধীনতার লক্ষ্যে বাঙালী জাতির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ‘তোমাদের যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো’। বাঙালি জাতি মানসিকভাবে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। বাঙ্গালীরা একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ স্বাধীন করার জন্য। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো পুরোপুরি আসেনি। এটা আমাদের জন্য বড় ধরণের ব্যর্থতা।

এবার মায়ের কাছ থেকে শোনা আমাদের পারিবারিক জীবনের একটি স্মৃতিকথা-
১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর এই দিনে আমরা ঢাকা থেকে মেহেরপুর যাত্রা শুরু করেছিলাম। তখন আমি মায়ের কোলে যে ইতিহাস বড় হয়ে মায়ের কাছে জেনেছি। বইতে পড়েছি, পত্রিকাতে পড়েছি। আমি বলছি আমাদের ঘটনা। ঢাকা থেকে মেহেরপুর যেতে আমাদের ১১ দিন সময় লেগেছিল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কিভাবে আমার ভাইকে নির্যাতন করেছিল তাই লিখব। গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করবো, ভুল হলে ক্ষমা চাই।

যুদ্ধ শুরুর আগেই ভাই ঢাকাতে থাকতেন। আমরা ৬ বোন ১ ভাই। ভাই সবার বড় ছিলেন। ৭ ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। বাবা কলকাতাতে ব্যবসা করতেন , সে সময় শুধুই হরতাল হতো। বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল । একদিন ঢাকায় একমাত্র ছেলেকে দেখতে গেলেন। হরতাল চলছে ভাইয়ের সাথে আর যোগাযোগ করতে পারছেন না। একসময় দেখতে পেলেন সবুর খানের বিল্ডিং-এ আগুন জ্বলছে। সবুর খানকে আমি আজো চিনিনা। বাবা ধরে নিয়েছিলেন ওই বিল্ডিং এ তাঁর ছেলে আছে । একমাত্র ছেলের শোক সইতে না পেরে হার্টফেল করেছিলেন। ঢাকা থেকে মেহেরপুর পৌঁছে আমাদের সবাইকে ছেড়ে বিদায় নিলেন। তার কিছুদিন পর ভাই বাড়িতে গেলেন। ২ বোন শ্বশুরবাড়িতে আর আমরা ৪ বোন মা আছি। ভাই ৩ আর ৪ নম্বর বোনকে বাড়িতে রেখে আমাকে আর মধু বোনকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসলো। আমি তখন ১ বছরের। ঢাকায় প্রথমে গুলিস্তান এলাকায় একটা হোটেলে উঠেছিলাম। আমরা মার্চ মাসের ১৫ তারিখে পৌঁছেছিলাম। শুধুই হরতাল আর কারফিউ, আমরা বের হতে পারতাম না। পরে রহিমা খালার (চলচিত্র অভিনেত্রী) সহযোগিতায় খিলগাঁতে ১৫০ টাকা ভাড়ায় বিশাল বড় বাসা পেয়েছিলাম। ভাই আমাদের রেখে কাজে যেতেন আর রহিমা খালা খোঁজ খবর নিতেন। ২৬ মার্চ রাতে গুলাগুলির শব্দ। ভাই আমাদের সবাইকে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন, কাঁচের জানালা ভেঙ্গে গুলি আসছিল ঘরের মধ্যে । সকাল হলে ভাই আমাদের নিয়ে আর কিছু হাঁড়ি পাতিল নিয়ে শরণার্থীদের সাথে নিরাপদ স্থান খুঁজতে লাগলো। টঙ্গীতে এক জঙ্গলের মধ্যে একজনের বাড়িতে আমাদের রেখে ভাই যুদ্ধে ট্রেনিং নিতে গেলেন। জঙ্গল বলতে মা বলেছিলেন অনেক গাছ গাছালি ঘেরা নির্জন বাড়ি। ভাই ট্রেনিং করে মাকে বললেন আমাদের কুমিল্লা যেতে হবে । আমাদের সাথে নিয়ে যাবে । ওদিকে ভাবী ৩ ছেলে নিয়ে মেহেরপুরের গাংণীতে তার বাবার বাড়িতে। কারো কোন খোঁজ নেই...। যে ২ বোনকে বাড়িতে রেখে এসেছে মা তাদের জন্য প্রতি রাতে কান্নাকাটি করতেন। ভাই খবর নিয়ে আসতো মিলিটারিরা মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। একদিকে বাবা হারানো শোক আর অপরদিকে ২ বোনের জন্য মায়ের আকুল আহাজারি! কিছুদিনের মধ্যে খবর আসলো আমার ফুফাতো ভাই ২ বোনের বিয়ে দিয়েছেন। তারা ভাল আছে। কিন্তু ৪ নম্বর বোনের স্বামী কলেজ ছাত্র । তিনি বিয়ে করেই যুদ্ধে চলে গেছেন। মায়ের চিন্তা আরও বেড়ে গেল । ঘরে কোন খাবার নেই। ভাই একেকদিন একেক এলাকাই যুদ্ধে যেতেন। আমি নাকি ক্ষুধার জ্বালায় চিৎকার করে কান্না করতাম। মধু বোন ছিল চুপচাপ (এখনো মধু তেমনি আছে)। কুমিল্লা থেকে আবার আমাদের ঢাকায় খিলগাঁ বাসায় নিয়ে আসলো । রহিমা খালা মাঝে মধ্যে খাবার দিয়ে যেতো । একদিন ভাই আর বাসায় ফিরেনি। খবর আসলো মিলিটারিরা ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে । মা এই খবর পেয়ে নাকি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন । এইসব গল্প যখন মা বলতেন আমি ভয়ে শিহরি উঠতাম । আমার লেখার প্রতিটি কথায় মায়ের মুখে শোনা । আপনাদের যদি ভাললাগে আমি লিখতেই থাকব । অনেক ভয়ংকর ঘটনা আছে পরে লিখব।

পাক মিলিটারিরা ভাইকে মেহেদীর ডাল (বেত) দিয়ে মেরে সারা শরীর খত বিক্ষত করেছিল। মা আমাদের নিয়ে সারারাত জেগে থেকেছে। ভাইয়ের কোন খবর নেই , একজন লোক এসে খবর দিল আপনার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলবে তাই শেষ ইচ্ছা মা আর ছোট ২টা নাবালিকা বোনকে দেখবে। লোকটাকে মা চিনে ফেলেছে। ভাইকে লোকটাই ধরিয়ে দিয়েছে। শান্তি কমিটির লোক। মা বললেন যাব, ছেলের সাথে যেন আমাদেরকেও গুলি করে মেরে ফেলে। এমনিতে না খাওয়া রহিমা খালারা অন্যত্র চলে গেছে। মিলিটারিরা একের পর এক বাড়ি ঘর বোমা মেরে জালিয়ে দিচ্ছে, মা পাথরের মত বসে আছে। এমন সময় শান্তি কমিটির লোক আর ২/৩ জন মিলিটারি ঠেলাগাড়িতে করে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে ভাইকে নিয়ে আসলো। মা বুঝতে পারল বাবার মত ছেলের লাশ আসলো। কোন কথায় বললেন না, শুধুই তাকিয়ে দেখলেন। ওনারা কাপড় সরিয়ে মুখটা বের করল ভাই মায়ের মুখের পানে চেয়ে আছে। একটু একটু পলক নড়ছে, মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আমরা ২ বোন ভাইয়ের কাছে , এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখে মিলিটারিদের মায়া হল তাদের হয়তো আমাদের মত মা বোন ছিল তাই ভাইকে আমাদের কাছে রেখে চলে গেল। কিন্তু ভাই নড়াচড়া করতে পারছেনা, কথা বলতে পারছেনা মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবে। আমার মায়ের চেহারা হয়েছিল পাগলিনীর মত। কি করবে কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারছিলনা। এর মধ্যে শান্তি কমিটির একজন লোক এসে বলল আপনারা বের হবেন না বের হলে মিলিটারিরা গুলি করবে। আপনার ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছি জানতে পারলে আমাকেও গুলি করে মারবে।

কত যে ভয়ংকর জীবন পেরিয়ে আমার মা আমাদের মানুষ করেছিল! লঞ্চে নদীর মাঝখানে আমরা ৪ রাত ৪ দিন ছিলাম। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মায়ের চুল ধরে টানা ছেঁড়া করতাম, পরে ভাই সবাইকে নিয়ে লঞ্চের মধ্যে খাবার হোটেলে নিয়ে গেলেন। মা বললেন টাকা নেই হোটেলে কেন? তখন ভাই বললেন আগে ভালমতো খেয়ে নাও টাকার চিন্তা পরে হবে। খাওয়া শেষ হলে বিল দেবার জন্য দাঁড়িয়েছে, কয়েকজন লোকের দেয়ার পর ভাই গেছে বললেন আমার বাকি টাকা ফেরত দেন, হোটেল মালিক বললেন টাকা দিলেন কখন? ভাই বললেন কালির দাগ দেয়া ২০ টাকার নোট , খুঁজে দেখেন (একটু আগে একজন দিয়েছিল ভাই তা খেয়াল করে এই বুদ্ধি বের করেছিলেন)। পরে বাকি টাকা ফেরত পায়। ক্ষুধা পেলে মানুষের রুপ কি হয় তা যার ক্ষুধা পায় সেই বুঝে । লঞ্চের ছাদ বেয়ে ইলিশ মাছের পানি পড়ে আমাদের পরনের জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে । একেই বলে যুদ্ধ! যুদ্ধ করিনি, কিন্তু যুদ্ধের স্বাদ কি তা ভাইয়ের মুখে শুনেছি। অবশেষে লঞ্চ তীরে ভিড়ল। একটি বাড়িতে আশ্রয় চাইল মা , কারণ পথে পথে মিলিটারি । দেখামাত্র গুলি করছে। উপর দিয়ে বিমানে বোমা ফেলছে। কি যে ভয়ংকর সময় গেছে! যে বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলাম মাটির নিচে গর্ত করে গুহা বানিয়েছিল বোমা পড়ার ভয়ে । বিমান উড়লেই সবাই গুহার মধ্যে থাকতাম। গ্রামে কখন যাবো - সেই চিন্তায় অস্থির থাকতেন মা আর ভাই কিন্তু যেতে পারতেন না । ভাই সুস্থ হলে মিলিটারি ক্যাম্পে আঁচল পেতে মা ভাইয়ের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন! এইবারও ভাই ছাড়া পেলেন! কিন্তু তার শরীরের অবনতি হতে থাকে, বাসে করে আমরা চুয়াডাঙ্গা এসে পড়েছি, দোতালা একতলা বিল্ডিং গুলো আগুনে পুড়ে ইট বের হয়ে আছে । কোন মিলিটারি চোখে পড়ছে না, কয়েকজন পথচারি বলল, মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের হটাও করেছে। মা এবং ভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ভাই ঢাকাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে ৫ মাস যুদ্ধ করেছেন , যুদ্ধকালীন অবস্থায় বাসায় ফেরার পথে শান্তি কমিটিরা ভাইকে চিহ্নিত করে মিলিটারিদের হাতে ধরিয়ে দেয়। মিলিটারিদের অমানুষিক নির্যাতনে ভাই তিলে তিলে ক্ষয় হচ্ছে। ভাবী ৩ ছেলে সহ বাপের বাড়ি গাংনিতে (মেহেরপুর) আছে। এত কিছু ঘটনা তারা কিছুই জানেনা। মা বাড়িতে যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। মায়ের ধারনা ভাইকে আর বাঁচানো যাবেনা। তারপরও হাল ছাড়েনি। আমরা বাড়ি এসে পড়লাম, কেউ নেই বাড়িতে। যে দুলাভাই যুদ্ধে গিয়েছেন, সে বোন দুলাভাইকে দেখতে গিয়েছেন। দুলাভাই শেষ বেলায় মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়েছেন! ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে লেবুর রস আর লবন মিশিয়ে দুলাভাইকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। বোন খবর পেয়েছে চুয়াডাঙ্গা ব্রিজের নিচে লাশ পড়ে আছে। দুলাভাইয়ের নাম খাইরুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গা জেলার মজলিসপুর গ্রামে বাড়ি। এদের নাম ভাইয়ের নাম কখনো পত্রিকাতে ছাপানো হয়নি । নতুন বিয়ে করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন! বোন শোকে পাথর হয়ে গেছে। ভেবেছিল আমরাও বেঁচে নেই, বাড়িতে এসে আমাদের দেখে কেঁদে ফেললো। এইসব কষ্ট যুদ্ধের চাইতেও কঠিন। মেহেরপুর তখন শত্রু মুক্ত হয়নি। যুদ্ধকালীন সময়ে ২ বোনের বিয়ে হয়েছিল এক বোন মেহেরপুর আর এক বোন চুয়াডাঙ্গা মজলিসপুরে। মেহেরপুরের বোনের শ্বশুর বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে সব পুড়িয়ে ফেলেছিল। তাই বোনরা সবাই ভারতে পালিয়ে গেছে।

আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা তুলে ধরলাম। এমন হাজারো স্মৃতিকথা ছড়িয়ে আছে গ্রাম বাংলায়। সকল স্মৃতিকথাগুলো তুলে ধরা উচিত।