কাজী আনিছ


আগে বাসে বা যানবাহনে লেখা থাকত, 'ব্যবহারে বংশের পরিচয়', 'সদা সত্য কথা বলিবে', 'মিথ্যা বলা মহাপাপ', 'সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি', 'লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু'।

এখন আর এগুলা নাই। এখন দেখি, 'হাফ পাশ নাই', '১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট ভাংতি নাই', 'ইহা ছয়জনের সিট'।

প্রতিদিন বাসে কর্মস্থল ভার্সিটিতে যাই। মাঝেমাঝে রেসলিংয়ের রেফারির ভূমিকা পালন করতে হয়। এমন একটা দিন নাই, কন্ডাক্টরের সঙ্গে যাত্রীদের কাইজ্জা লাগে না। যাত্রী বলে, 'আমি স্টুডেন্ট।হাফ ভাড়া।' কন্ডাক্টর বলে, 'স্টুডেন্ট তো তাইলে পড়তে পারেন। পড়েন না, কী লেখা আছে?' আগ বাড়িয়ে মাঝে মাঝে সমাধান করি।

কিন্তু হাল আমলে সিটিং সার্ভিস বন্ধের অভিযান শুরুর পর কাইজ্জা বেড়েছে। যাত্রীরা এখন কিলোমিটার হিসেবে টাকা দিতে চায়। কন্ডাক্টর চায় আগের ভাড়া।হায়রে কী ঝগড়া। আমি প্রতিদিন বাসে যেতে যেতে কানে হেডফোন দিয়ে বিবিসি শুনতে শুনতে যাই। কিছুদিন আগে বাসে যেতে যেতে খবর শুনছি। প্রেজেন্টার খবর পড়ছে, 'দি ইউএস ফ্রেসিডেন্ট ঢোনাল্ড ঠ্রাম্ফ হেজ সেড, তোরে এখনই কান বরাবর চটকানা লাগামু কইয়া দিলাম। জানোয়ারের বাচ্চা।'

আমি তড়ক করে উঠলাম।ট্রাম্প কারে চটকানা দেয়? হেডফোন খুলে দেখি, এক যাত্রী কন্ডা্ক্টরকে চেইত্যা মেইত্যা এখনই মারতে যাবে। আর এতই উচ্চ আওয়াজে যে, বিবিসির প্রেজেন্টার ফেইল।

কাইজ্জা বেড়ে যাওয়ায় আমি এখন আর রেফারির ভূমিকাও পালন করি না। রেসলিংয়ে দেখেছি, পালোয়ানগুলা মাঝেমাঝে মেজাজে উঠে রেফারিরে উপড়ে তুইলা ছুইড়া মারে।' এখন বাসে উঠলে আমার ওই দৃশ্য চোখে ভাসে। তাই নীরবে যাতায়াত করি।

আসলে একটি দেশ কত সভ্য, তা বোঝার বিভিন্ন সূচক আছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, সবচেয়ে সহজ ও সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে, ওই দেশের গণপরিবহনের ভিতরে মানুষগুলো কেমন-তা দেখা। এটি শুধু দেশের ক্ষেত্রেই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ সম্পর্কে ধারণা পেতে এ ফর্মুলা ব্যবহার করা যেতে পারে। ঢাকা শহরের মানুষগুলো যে দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছি বা গেছি তা তো বাসের হাল আমলে ঝগড়া বিবাদেই বোঝা যায়। কী যাত্রী বলেন, কী হেলপার বলেন আর কী ড্রাইভার বলেন। রীতিমতো ঢাকা শহরে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এমন কথার গৃহযুদ্ধ চলে। কারণ হয়তো বিভিন্ন। তবে আগেরকার বাণীগুলো না থাকাটাও মনে হয় একটা কারণ।

নীতি নির্ধারকেরা বিভিন্ন সময়ে উন্নয়নের নীতিনির্ধারণ করেন। আমার মনে হয়, মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করার উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাস বা গণপরিবহন হতে পারে একটা প্লাটফর্ম। অন্তত ব্যবহার ও আচার আচরণ নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষণ কার্যক্রম চলতে পারে। আর এক্ষেত্রে আগেরকার বিভিন্ন বাণীসংবলিত স্টিকার বা লেখাগুলোর প্রত্যাবর্তন ঘটানো যেতে পারে।

মানুষ যতক্ষণ না বাসায় কিংবা অফিসে থাকে, তার চেয়ে বেশি সময় কাটায় রাস্তায় গাড়ির ভিতরে। যানজট যেহেতু কমছেই না, এ সময়টাকে কাজে লাগানো উচিত। বাসের ঝগড়াটা হয়তো পারিবারিক, পেশা কিংবা ব্যক্তিজীবনেও প্রভাব ফেলছে।

কে জানে, জব্বার আলী আজকে অফিসে গিয়ে যে হিসাবটা ভুল করে বসের ঝাড়ি খেল, তার নেপথ্যে অাছে বাসের কন্ডাক্টর ফজর আলীর সঙ্গে ঝগড়া। অফিসে গিয়েও মেজাজটা তখনও কিড়মিড় করছিল জব্বার আলীর।

কে জানে, কন্ডাক্টর ফজর আলীও সারাদিন ঝগড়ার পর্ব শেষ করে বাসায় ফিরে তার স্ত্রী সন্তানদেরও যাত্রী মনে করে চিল্লানি শুরু করে দিয়েছে।

না হলে ফজর আলীর ঘর থেকে স্ত্রী বা সন্তানদের কান্নার আওয়াজ আসে কেন?

লেখকঃ সিনিয়র লেকচারার, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।