অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত


১৯৭১ সালে বাঙ্গালি জাতি যুদ্ধ করেছিল কিসের বিরুদ্ধে? ৭১ এর যুদ্ধ ছিল মূলত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়, অবিচার, শোষন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। সে সময় বাংলার মানুষের জন্য ছিল একখণ্ড ভূমি আর একটি কাগুজে সংবিধান, কিন্তু ছিলনা সে ভূমিতে আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার তথা কোন সাংবিধানিক অথবা মৌলিক অধিকার।  বরং প্রতিনিয়ত শোষণ, নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। আজ আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহিদের রক্ত আর চার লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি, পেয়েছি একটা উন্নত সংবিধান। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও কি আমরা শোষণ, বৈষম্য আর নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত হতে পেরেছি?

স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও আজ আমরা যেন পরাধিনতার শিকলে আবদ্ধ। এখনো প্রতিনিয়ত ভুলন্ঠিত হচ্ছে মানবতা। প্রতিটি সেক্টরে চলছে ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, শোষন, বৈষম্য আর নির্যাতন। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম, খুন আর নির্যাতন যেন নিত্য নৈমত্যিক ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত বছরগুলোর খতিয়ান দেখলে একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে দিনে দিনে দেশের আইনশৃংখলা আর মানবাধিকার পরিস্থিতির শুধু অবনতিই হয়নি চরম আকার ধারন করেছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, গণ পিটুনিতে নিহত, শ্রমিকের নিরাপত্তাহিনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সভা –সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা, নারী ও শিশু পাচার, নাস্তিকতার নামে ব্লগার আর সমকামী অধিকারকর্মি হত্যা, মতামত প্রকাশে বাঁধা, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক গুম, সন্ত্রাস ও ইসলামী জঙ্গি দমনের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে দেশের আইন শৃংখলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের আলোকে বাংলাদেশের মহান সংবিধানে মানুষের আত্বনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও মর্যাদাকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়া হয়েছে। আমাদের পবিত্র সংবিধানে জাতি, ধর্ম, লিংগ, বর্ণের কারনে যেন কোন প্রকার বৈষম্যের সৃষ্টি না হয় অথবা সকল নাগরিকের জীবনের নিশ্চয়তা সহ নির্যাতন থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। যদিও আমাদের দেশে বর্ণ বৈষম্য নেই বললেই চলে তারপরও দিনে দিনে জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বেড়ে চলেছে। দিনে দিনে ধর্মীয় মৌলবাদ তথা জঙ্গিবাদ তীব্র আকার ধারন করে চলেছে।

বাংলাদেশে বর্ণ বৈষম্য খুব কম পরিমান চোখে পড়লেও বর্তমানে সংখ্যা লঘু আদিবাসি ও দলিত জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেকাংশে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ভূমি সমস্যায় আদিবাসীরা আর কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যে দলিত শ্রেণী জর্জরিত। আদিবাসীরা জংলী আর দলিত শ্রেণীরা অস্পৃশ্য এ ধরণের মনোভাব অধিকাংশ বাঙালির মধ্যে বিদ্যমান। আদিবাসী আর দলিত শ্রেণী অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের আদিবাসি ও দলিত শ্রেনীর মত আমাদের দেশেও আদিবাসী ও দলিতশ্রেণীর নেই কোন সাংবিধানিক স্বীকৃতি অথবা আইনগত নিরাপত্তা। যদিও সামান্য কিছু অধিকার থেকেও থাকে কিন্তু সেসবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় না বললেই চলে।

অধিকাংশ আদিবাসী এখনো মনে করে বসত ভিটা থেকে উচ্ছেদ যেন তাদের জীবনেরই একটি অংশ। আদিবাসিরাও যে বাংলাদেশের নাগরিক, তাদেরো যে ভূমির অধিকার রয়েছে আমরা যেন তা ভুলেই গেছি। তাইত বিদ্যমান আইন অনেক সময় নিপীড়িত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হচ্ছে। কি পাহাড়ী আর কি সমতলের-আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। আদিবাসীদের বসত ভিটা ও শস্য ফলানোর ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন দলীয় লোকেরা ভোগ করছে।

শুধু ভূমি থেকেই উচ্ছেদ নয়, বিভিন্ন মহল আদিবাসী মহিলাদের ধর্ষণ, শ্লীলতাহানী, নির্যাতন, অপহরণ ও হত্যার মত যঘন্য ঘটনাও ঘটিয়ে চলেছে। অথচ পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে পুলিশ প্রশাসন ও আদালতে গিয়ে যে বিচার চাইবে সে সুযোগও তারা পায় না । অসহায় অবহেলিত আদিবাসীদের প্রতিবাদের কোন ভাষা নেই, নেই কোন স্থান যেখানে গিয়ে তাদের বঞ্চনার কথা জানাতে পারে, নির্যাতনের কথা বলতে পারে, পেতে পারে ন্যায় বিচার।

বিচার পাওয়ার অধিকার আমাদের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার, হোক না সে সন্ত্রাসী বা জংগী। কেউ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত হলে অবশ্য তাকে গ্রেফতার করে প্রকাশ্য আদালতে বিচার করতে হবে। কিন্তু ইদানিং আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক সন্ত্রাসী গ্রেফতার পরবর্তী সময়ে অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে ক্রসফায়ার বা এনকাউণ্টারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড অথবা সাদা পোশাকে রাজনৈতিক কর্মীদের উঠিয়ে নিয়ে গুম করা এবং পরবর্তীতে নির্জন জায়গা থেকে তাদের লাশ উদ্ধার কিংবা জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের মাধ্যমে বিচার বহির্ভূত হত্যা কান্ড।

জীবণের অধিকার প্রত্যেকের সহজাত অধিকার। কোন অজুহাতে সে অধিকার লংঘন করা যায় না। আমাদের মহান সংবিধান সন্ত্রাসী দমন বা জঙ্গি দমনের নামে কোন বাহিনীকেই বিনা বিচারে হত্যা সমর্থন করে না। বিনা বিচারে হত্যা স্পষ্টত সংবিধান, প্রচলিত আইন ও মানবাধিকারের চরম লংঘন। যে দেশের সংবিধান জনগনকে দেশের মালিক আর প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জনগণের সেবক হিসেবে ঘোষণা করেছে সেদেশে কিভাবে এত দুর্নীতি আর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে?

একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান শর্ত হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। কারণ আইনের শাসন ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব। সমাজের প্রতিটি স্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অপরিহার্য। আবার গণতন্ত্র ছাড়াও উন্নয়ন অচল। কিন্তু গণতন্ত্রের পূর্ব শর্ত হলো মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার হচ্ছে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটি ছাড়া অপরটি অচল। সে কারনে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের প্রতিটি স্তরই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও প্রভাবশালী মহলের প্রভাবমুক্ত করা একান্তভাবে জরুরী।

নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার তত্ত্বে দাবি করেছেন, মানবাধিকার ছাড়া উন্নয়ন অর্থবহ হতে পারে না। আবার উন্নয়নের অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ ঘোষণায় “উন্নয়নের অধিকার” কে একটি মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যেহেতু মানুষের জন্যই অর্থনীতি-অর্থনীতির জন্য মানুষ নয়। মানব উন্নয়ন হচ্ছে অভীষ্ট লক্ষ্য, আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেই লক্ষ্য অর্জনের উপায়। সর্বোপরি মানুষের সক্ষমতার বিকাশই হচ্ছে উন্নয়ন।

মানব সম্পদের উন্নয়ন করতে হলে তাকে স্বাধীকার দিতে হবে। আর এই স্বাধিকারগুলো অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন, কর্মসংস্থান, বাক ও মতামত প্রদানের স্বাধীনতা, সভা–সমাবেশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতা, বাধাহীনভাবে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার, ভোটাধিকার অর্থাৎ প্রভাবমুক্তভাবে নিজে নির্বাচিত হোয়া ও অন্যকে নির্বাচিত করার পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এই স্বাধিকারগুলো যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে তার সক্ষমতার বিকাশ হতে থাকবে। সে তখন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে পারবে। আর তখনই সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষম্য দূর হবে এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে।

লেখক : মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও ব্লগার; জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ড।