শরীয়তপুর প্রতিনিধি : হাসপাতালের ফ্লোরে শুয়ে শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ছেলেটি। পরিচিত কাউকে দেখলেই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। কোন কিছু জানতে চাইলেই শুধু বিলাপ করে। তার সব স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল, নিভে গেল তার সোঁনালী সম্ভাবনার প্রদীপ। কেটে ফেলা দুটি হাত দিয়ে আর কোন দিন কিছু করতে পারবে না সিয়াম। গ্রামের সহপাঠিদের সাথে আর কোন দিন হৈ হুল্লুড়ে মেতে উঠে খেলতে পারবেনা ক্রিকেট। সিয়াম স্বপ্ন বুনছিল কলেজ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে কোন ভালো চাকুরী খুঁজে নিবে। দুর করবে দরিদ্র শ্রমজীবী বাবার সকল অভাব। কিন্তু  সে স্বপ্ন মুহুর্তেই ধুলোয় মিশিয়ে দিলো পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা।

শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা আর গাফলতির কারণে ঝড়ে ছিড়ে যাওয়া বিদ্যুতের তার শরীরে জড়িয়ে মারাত্মক রকমের আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি রয়েছে নড়িয়া সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেনির ছাত্র সিয়াম। তার বাবা ফারুখ খান একজন জাহাজ শ্রমিক। চাঁদের মত সুন্দর শান্ত স্বভাবের এই কলেজ ছাত্র আজ হাসপাতলের ফ্লোরে শুয়ে তার অনাগত সোনালী স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার কষ্টে আর শরীরের মরণ যন্ত্রণায় এখন শুধুই প্রলাপ বকছে।

গত ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় কাল বোশেখীর ঝড়ে বিদ্যুতের তার ছিড়ে পরে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলা বিঝারী ইউনিয়নের উত্তর বিঝারী জামে মসজিদের পাশে। তৎক্ষনাত এলাকার লোকেরা পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন আর ছিড়ে পরা লাইনটি মেরামতের অনুরোধ জানায়। এলাকাবাসীর অনুরোধ কর্ণপাত না করে বিদ্যুৎ সঞ্চালন চালু রাখে পল্লী বিদ্যুৎ। ৬ তারিখে জোহরের নামাজ পরে মসজিদ থেকে বেড় হয়ে সিয়াম ছিড়ে পড়া বিদ্যুতের তারের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল তার টিউশনির ছাত্র পড়াতে। হঠাৎ করেই বিকট শব্দে চারিদিক প্রকম্পিত করে ওই ছেড়া তার জড়িয়ে ধরে সিয়ামকে। মুহুর্তেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে পাশের ডোবায় পরে যায় সিয়াম। এরপর এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে প্রথমে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।

আজ তিন সপ্তাহেরও অধিক সময় ধরে মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে সিয়াম। হাতে পচঁন ধরায় চিকিৎসক একে একে সিয়ামের দুটি হাতই কব্জি এবং কুনুইর উপর থেকে কেটে ফেলেছেন। হাসপাতালের ওয়ার্ডে কোন বিছানা না পেয়ে সিয়ামের ঠাঁই হয়েছে এখন ফ্লোরে। কাউকে দেখলেই সিয়াম হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলে আর বিলাপ বকে স্বপ্ন পূরণে পল্লী বিদ্যুৎ তার বাধা হওয়া নিয়ে। গত ১২ এপ্রিল প্রথমে সিয়ামের বাম হাত এবং ১৬ তারিখে ডান হাত কেটে ফেলা হয়। মেরুদন্ডেও আঘাত রয়েছে প্রচন্ড। যার চিকিৎসা দেশে হওয়া দুরহ। দেশের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন ওর শরীয়র পুরো সুস্থ্য না হতে এবং শরীর থেকে ঘাটতি হওয়া শক্তি ফিরে না আসতে কোন অবস্থাতেই মেরুদন্ডে অস্ত্রপচার সম্ভব হবেনা। কিন্তু, ভয় থেকে গছে সেখানেই, এরই মধ্যে আবার না হয় মেরুদন্ডের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। তাই সিয়ামকে বাঁচিয়ে রাখতে জরুরী ভিত্তিতে দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু সিয়ামের বিদেশে চিকিৎসার খরচ কে জোগাবে ?

পিতার দারিদ্র দশার কারণে নিজের পড়ার খরচ টিউশনি করে নিজেই জোগাড় করতো সিয়াম। এতবড় দূর্ঘটনায় মা বাবা সিয়ামের চিকিৎসা করতে এতদিনে শুধু বসত ভিটা ছাড়া বাকি সব টুকু সহায় সম্পদ বিক্রি করে দেড় লাখেরও বেশী টাকা খরচ করেছেন হাসপাতালে। এখন এই দরিদ্র মেধাবী কিশোরের চিকিৎসা চালিয়ে নিতে প্রয়োজন সরকারি বা সমাজের বিত্তবানদের সহায়তা।

বৃহস্পতিবার এই প্রতিনিধি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ব্লু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা করেন সিয়ামের সাথে। সাংবাদিক পরিচয় পেতেই অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সিয়াম। তাকে শান্তনা দেবার কোন ভাষাই ছিলোনা কারো কাছে। হাসপাতালে কোন বেড বা বিছানা জুটেনি সিয়ামের ভাগ্যে। তাই ফ্লোরেই কাটছে তার রাত-দিন। পাশে বসে সারাদিন মা নাজমা বেগম ছেলের শুশ্রুষা করে যাচ্ছেন। সিয়াম প্রতিবেদককে জানান তার স্বপ্ন ভঙ্গের কথা। তিনি সরকার ও দেশবাসির সহায়তা কামনা করেন এখন শুধু বেঁচে থাকতে।

সিয়ামের বন্ধু সোহান ও আল আমিন জানান, সিয়াম খুব মেধাবী ও পরিশ্রমি ছাত্র। ওর বাবা ওর পড়ার খরচ জোগাতে না পারার কারণে দিনে তিন চার বার টিউশনি করে নিজের সকল খরচ বহন করতো। ওর বড় হয়ে চাকুরী করার আশা ছিল। কিন্তু পল্লী বিদ্যুতের লোকেদের অবহেলার কারণে আজ ওর দুটি হাত কাটা পড়লো। আমরা পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের যথাযথ বিচার দাবি করছি। আর সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ সিয়ামকে যেন সরকারি খরচে বাকি চিকিৎসা ও লেখা পড়ার দায়িত্ব সরকার গ্রহন করেন।

উত্তর বিঝারী গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মজিবুর রহমান ঢালী বলেন, ৫ এপ্রিল সন্ধ্যার একটু আগে তুফান এসে একটি মরা শিশুগানি গাছ বিদ্যুতের তার নিয়ে মাটিতে পরে যায়। আমি সন্ধ্যা ৭ টা ১৪ মিনিটের সময় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করে লাইনটি মেরামত না করে বিদ্যুৎ সঞ্চালন চালু না করার জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ৬ তারিখ দুপুরে বিদ্যুৎ সঞ্চালন চালু করে। ওই দিন জোহরের নামাজ শেষে সিয়াম ছিড়ে পড়া তারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায়। আমরা ওকে অজ্ঞান ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতলে নিয়ে যাই।

হাসপাতালে সিয়ামের মা নাজমা বেগম বলেন, আমার ছেলের চিকিৎসা করেত এ পর্যন্ত প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ওর বাবা খুলনায় একটি জাহাজে শ্রমিকের কাজ করে। আমার ছেলে সুস্থ্যতার জন্য আমি দেশের মানুষের দোয়া ও সহায়তা কামনা করছি। আর যাদের গাফলতির কারণে সিয়ামের আজ এ অবস্থা তাদের শাস্তি চাই।

নড়িয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আব্দুল খালেক বলেন, সিয়াম আমার কলেজের একাদশ শ্রেনীর একজন দরিদ্র মেধাবী ছাত্র। ওর চিকিৎসার জন্য আমরা কলেজ তহবিল থেকে যথাসম্ভব আর্থিক সহায়তা প্রদান করবো। পাশাপাশি আমি এলাকার দানশীল ও বিত্তবানদের অনুরোধ করবো তারা যেন সিয়ামের সাহায্যে এগিয়ে আসেন।

শরীয়তপুর জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহা ব্যবস্থাপক মো. সোহরাব আলী বিশ্বাস বলেন, দায়িত্বে অবহেলার কারণে ইতিমধ্যে কোম্পানীর দুইজন স্টাফকে বরখাস্ত করা হয়েছে। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্যান্য দোষী বা দায়ী ব্যক্তিদের তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরো জানান, আমি সিয়ামের চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছি। কিন্তু সিয়ামের পরিবারের দাবি, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বা অপর কারো কাছ থেকেই সিয়ামের চিকিৎসার জন্য এখনো কোন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়নি।

(কেএনআই/এএস/এপ্রিল ২৮, ২০১৭)