প্রবীর সিকদার


এই দেশে তিন ধারার রাজনীতি। একটি মূলধারা, যে ধারার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ। আরেকটি বিকৃত ধারা, যে ধারাটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ধারা তথা আওয়ামীলীগ বিরোধী ধারা। অপর ধারাটি হচ্ছে, সাধারণ ভোটার শ্রেণী; ওরা ভোট নষ্ট করতে চায় না; যেদিকে পাল্লা ভারী মনে করে, সেই দিকেই ভোট দেয়।

আওয়ামীলীগ বিরোধী ধারাটি দুর্বল নয়, বেশ শক্তিশালী। আওয়ামীলীগ সরকার দেশের যতো উন্নয়নই করুক না কেন, আওয়ামীলীগ বিরোধীরা যতোই দলে দলে আওয়ামীলীগে যোগদান করুক না কেন, আওয়ামীলীগ বিরোধীরা কখনোই নৌকায় ভোট দেয় না, দিবেও না। আওয়ামীলীগ বিরোধী শিবিরে যখন অনৈক্য থাকে তখন নৌকার সহজ জয় হয়। কিন্তু আওয়ামীলীগ বিরোধী শিবির যখন ঐক্যবদ্ধ থাকে তখন নৌকার জয়লাভ বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যায়। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ভেবেছিল, তাদের সরকার ভালো কাজ করেছে; মানুষ অবশ্যই তাদের ভোট দিবে। কিন্তু ভোটের ফল বলে ভিন্ন কথা। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিরোধীরা একাট্টা হতে পেরেছিল বলেই তারা জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। ২০১৯ সালের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামীলীগ যদি নিজেদেরকে ২০০১ সালের নির্বাচনী কৌশলের মধ্যেই রাখে, তাহলে ফল হবে ২০০১ সালের মতোই। এবার আওয়ামীলীগ ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লে আওয়ামীলীগের কতোখানি ক্ষতি হবে, সেই হিসেব আওয়ামীলীগই রাখুক; কিন্তু অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মিনি পাকিস্তানের খোলস লাগিয়েছিল যে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জীবন বাজি রেখে সেই খোলস থেকে বাংলাদেশকে অনেকটাই বের করে আনতে সক্ষম হয়েছেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় ফিরতে ব্যর্থ হলে আবার বাংলাদেশ ফিরে যাবে ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট পরবর্তী ধারায় কিংবা তার চেয়েও ভয়াবহ কোনও অন্ধকার গহ্বরে।

একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিরা সাজা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী রাজনীতির পুরোধা বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত আইনী হুমকির মুখে পড়েছে। দেশের বাইরে থেকে চাপ দিয়েও ড. ইউনুসকে রক্ষা করা যায়নি। এই সব অনুষঙ্গ নিয়ে ভেবে চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরা সবাই একাট্টা হয়ে আওয়ামীলীগ ঠেকাতে মাঠে ও নেপথ্যে খুবই সক্রিয় থাকবে, এতে কোনও সন্দেহ নাই। আর সেই ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনের ফলাফল ২০০১-এর মতোই হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। আওয়ামীলীগ যদি এই কঠিন সত্য এড়িয়ে দলে উড়ে এসে জুড়ে বসা হাইব্রিডদের ওপর ভরসা করে ও ভোটারদের কাছ থেকে ভালো কাজের স্বীকৃতির প্রত্যাশা করে, সেটা হবে ভয়ংকর রকমের ভুল। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট যে মানুষ 'বঙ্গবন্ধুর কথা ছাড়া বাংলায় গাছের পাতা নড়ে না' বলে দম্ভ করে, সেই মানুষই যখন পরেরদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের ওপর দাঁড়িয়ে নাজাত দিবস পালন করেন, সেই ক্ষেত্রে ওই ভোটার শ্রেণীর ওপর কতোটা ভরসা রাখা যায়, সেটা আওয়ামীলীগকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে।

আওয়ামীলীগ বরাবর ক্ষমতায় আসার পর দলটির নিবেদিত প্রাণ কর্মী সমর্থকরা তীব্র অবহেলা ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন; এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিবেদিত প্রাণ কর্মী সমর্থকদের জন্য ট্রাজেডি হল, দল যখন ক্ষমতায় থাকে, ওরা চূড়ান্ত অবহেলার শিকার হন; আবার দল যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে, তখন ওরা চূড়ান্ত নির্যাতনের শিকার হন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয় নিশ্চিত করতে জরুরি ভিত্তিতে যে কাজটি করা দরকার, সেটি হচ্ছে, অবিলম্বে দলের কর্মী সমর্থকদের অভিমান ভাঙ্গানো। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে, উড়ে এসে জুড়ে বসা হাইব্রিডদের ওপর ভরসা করলে মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই হাইব্রিডদের সবাই তলে তলে আওয়ামীলীগ বিরোধী শিবিরের হয়েই কাজ করছেন। আওয়ামীলীগ যদি তার নিজস্ব কর্মী সমর্থক বাহিনীকে ঐক্যের ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারে, আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ অবশ্যই নিরঙ্কুশ জয় পাবে। আওয়ামীলীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে ভোটারদের কাছে বার্তা পৌঁছে যায়, এই আওয়ামীলীগকে হারানো যাবে না। অতএব ভোট নষ্ট করে লাভ নেই, ভোট দাও নৌকায়। আমরা যারা সাধারণ ভোটার, তারা পরাজিতদের দলে থাকতে চাই না। আওয়ামীলীগের সামনে সবচেয়ে বড় কাজ, কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে দলের ঐক্য সুদৃঢ় করে জানান দেওয়া, এই আওয়ামীলীগ ভোটে হারতে নির্বাচন করছে না; জয় তাদের এবারও সুনিশ্চিত। সাধারণ ভোটাররাও আওয়ামীলীগকে ভোট দিবেন বাক্স ভরে।

প্রচলিত অর্থে বলা হয়, আওয়ামীলীগ যখন জয়লাভ করে তখন আওয়ামীলীগের কিছু নেতা বিজয়ী হন। আর আওয়ামীলীগ যখন পরাজিত হয়, তখন পরাস্ত হয় সারা দেশ। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বকে সেই চিত্রটা বদলে দিতে হবে, আওয়ামীলীগের বিজয় দেশের বিজয়। যে আওয়ামীলীগ দেশের জন্য জয় বয়ে আনে, সেই আওয়ামীলীগের পরাজয় অসম্ভব। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু জয় শেখ হাসিনা।