মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল


পহেলা মে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস হিসেবে বিশ্বের প্রায় সব দেশে পালিত হয়। এদিন সরকারি ছুটির দিন। লাল-কালো ব্যাজ ধারণ করে আলোচনা সভায় চাপা কপচানি আর বড় বড় বুলি আউরানো হয়। মে দিবসের মূল চেতনা প্রতিষ্ঠা করার এতো এতো প্রতিশ্রুতি- অঙ্গিকার করা হয়। এদিনটি চলে গেলেই গতদিনের সব প্রতিশ্রুতি-অঙ্গিকার সব বেমালুম উবে যায়। মহান মে দিবসের মূল চেতনা দীর্ঘ সময় ধরেই ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। শুরুতেই শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ৮ ঘণ্টার ‘শ্রমঘণ্টা’ হয়েছে বটে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হয়নি মালিক-শ্রমিক সমতা।

আমাদের দেশে গরমে কাবু হয়ে মালিক শ্রেণি যখন প্রশান্তির ছায়ায় আশ্রয় খুঁজে, তখন শ্রমজীবী মানুষগুলোকে এতটুকু পর্যন্ত টলাতে পারেনা গ্রীস্মের উষ্ণতা। শ্রমজীবী মানুষগুলো প্রচন্ড দাবদাহকে উপেক্ষা করে তাদের কর্মে থাকছে অবিচল। এচিত্র গ্রীষ্মের হলেও শীতের চিত্রও বিপরীত নয়। কনকনে শীতের সকালে কম্বল-কাঁথা মুড়ি দিয়ে যখন মালিক শ্রেণি বদ্ধ ঘরে আরামের জন্য উষ্ণতা খোঁজে, তখনও এদেশের মেহনতি কৃষক কনকনে শীতকে চাঁদর বানিয়ে লাঙল-জোয়াল কাঁধে ছুটে যায় মাঠে ফসল বুনতে।

নিজের সত্তার কথা চিন্তা না করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে- রক্তকে পানিতে পরিণত করে যারা জীবনের বাঁকে শ্রমের তরীর মাঝি হিসেবে তরীকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে অকান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আজ সেই সকল মেহনতি মানুষের ঐক্যের প্রতীক মহান মে দিবস আজ। মহান দিবস সারা বিশ্বে পালিত হবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন শ্রমিক সমাবেশের মাধ্যমে এ দিবসটি উদযাপন করবে। মালিক-শ্রমিক একাতœতার মন ভুলানো নানা শ্লোগান দেবে। কিন্তু ন্যায্য পাওনা- যথাযথ অধিকার ও মর্যাদা দেবেনা। এ অবস্থার পরিবর্তন অত্যাবশ্যক।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, শ্রমিক আন্দোলনে সামন্তবাদী সমাজ ভেঙে পুঁজিবাদের উদ্ভব হওয়ার পাশাপাশি সমাজে দুটি প্রতিদ্বন্দ্ধী শ্রেণির বিকাশ ঘটে। এ শ্রেণিদ্বয় হচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণি। পঞ্চদশ-ষষ্ঠদশ শতাব্দী থেকে ইউরোপে পুঁজিবাদী সমাজ বিকশিত হতে থাকে। সামন্তবাদের তুলনায় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা অনেক বেশি প্রগতিশীল ছিল। পুঁজিবাদ ভূমিদাসদের ভূমির বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারের গোড়াপত্তন করে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ মালিকানায় সাম্য না থাকলেও আইনের দৃষ্টিতে সব মানুষই সমান এ প্রত্যয় প্রতিষ্ঠা করেছিল।

পুঁজিবাদের সৃজনশীল বৈশিষ্ট্য হলো, উৎপাদন যন্ত্র ও প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন বিকাশ ঘটিয়ে উৎপাদিকা শক্তির প্রবৃদ্ধি ঘটানো। এরই ফলশ্রুতিতে ভোক্তার কাছে পুঁজিবাদ বিপুল ও বিচিত্র ধরনের ভোগ্যদ্রব্য এবং উৎপাদনকারীদের জন্য বিচিত্র ধরনের উৎপাদন যন্ত্র বাজারে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ঊনবিংশ শতাব্দির নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সমাজতন্ত্রের পতনের পর মার্কিন অর্থনীতিবিদ জন কেনেথ গলব্রেথ দিল্লিতে এক সেমিনারে বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাদের টেকসই হওয়ার ক্ষমতা এসেছে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার মাধ্যমে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এ অন্তর্নিহিত শক্তি সত্তেও স্বীকার করতে হবে পুঁজিবাদ একটি শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থা।

এতে শ্রমিক ও মালিকের দ্বন্দ্ধ নিষ্পন্নযোগ্য নয়’। পরে পুঁজিবাদের ক্লাসিক বিকাশে গ্রাম থেকে কৃষকদের উচ্ছেদের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন একটি শিল্প বিপ্লবের পূর্ব শর্ত তৈরি করে। কারখানা মালিকরা নারী, পুরুষ ও শিশুদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে বাধ্য করে। শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। তীব্র শ্রমিক শোষণের মাধ্যমে পুঁজিপতিদের পুঁজি স্ফীত হতে থাকে। বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্য শ্রমিকদের কোনো সুযোগই ছিল না।

এ পরিস্থিতিতে ইউরোপে শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন হিসেবেInternational WorkingmenÕs Association গড়ে ওঠে। দার্শনিক কার্ল মার্কস এ সংগঠনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। শ্রমিকরা কর্মদিবস সুনির্দিষ্টকরণের দাবি তুলে। তারা ঘোষণা করে, তাদের ২৪ ঘণ্টার একটি দিন ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা সংগঠন ও ৮ ঘণ্টা বিশ্রামের মাধ্যমে বিভক্ত হবে। দার্শনিক কার্ল মার্কস ছিলেন পুঁজিবাদ বিরোধী দার্শনিক। শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়ে তিনি অগ্রজের ভূমিকা পালন করেন। এজন্যই মার্কেসের প্রতিটি গ্রন্থের শুরুতে লাল অক্ষরে লেখা হতো ‘Workers of all countries, unite.’ অর্থাৎ দুনিয়ার মজদুর এক হও।

শ্রমিকরা যে ভাষায়ই কথা বলুক না কেন, যে জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন, যে ধর্ম বা বর্ণের মানুষ হোক না কেন, তাদের পরিচয় একটি। তারা হলো, মেহনতি মজদুর শ্রেণিভুক্ত, মেহনতই তাদের বাঁচার একমাত্র সম্বল। তাই মার্কস বলেছিলেন,Workers of all countries, unite. You have nothing to lose but your chains! সামন্ত যুগের ভূমিদাসরা পরিণত হয় মজুরি দাসে। ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন একটি বিশেষ মাত্রা অর্জন করে। ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে বিক্ষোভ করতে গিয়ে শ্রমিকরা যেভাবে জীবন দিয়েছিল, তাকে স্মরণীয় করে রাখতেই আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস পালিত হয়ে আসছে।

আন্দোলন-সংগ্রামে জীবন দিয়ে শ্রমিক শ্রেণি তাদের নির্ধারিত কর্মঘণ্টা আদায় করতে পারলেও শ্রমিকদের প্রকৃত অধিকার সমুন্নত রাখার বিষয়টি আজও পরাভুত। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মিডিয়া শ্রমিকরাও মজুরি বৈষম্যে জর্জরিত- অধিকার হারা। মিডিয়া শ্রমিক বলতে এখানে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক শিল্পে কর্মরত মিডিয়াকর্মীদের বুঝানো হচ্ছে। কাগজপত্রে যা-ই থাকুক বাস্তবতা হচ্ছে মিডিয়া শ্রমিকরা সব শ্রেণি-পেশার শ্রমিকদের কথা ফলাও করে প্রচার করছে কিন্তু বাতির নিচে অন্ধকারের মতো তারা নিজেরা নিগৃহীত হচ্ছে।

সরকারি ঘোষণায় প্রিন্ট মিডিয়া শ্রমিকদের জন্য অষ্টম ওয়েজবোর্ডের মাধ্যমে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নকারী মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই মিডিয়া শ্রমিকদের শুভঙ্করের ফাঁকিতে ফেলে রেখেছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বিশেষ করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশনের প্রচার-সম্প্রচারে মিডিয়া শ্রমিকদের অধিকারে সর্বজন গ্রহনযোগ্য নীতিমালাই প্রণয়ন করা হয়নি। ওগুলো চলছে ‘মুই কর্তা’ অনুযায়ী অর্থাৎ হ য ব র ল অবস্থায়।

প্রিন্ট মিডিয়াগুলোর জেলা-উপজেলার প্রতিনিধি বা দালাল কিংবা শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হচ্ছে; নির্ধারিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেনা, কোন কোন ক্ষেত্রে নিয়োগপত্রও দেয়া হচ্ছেনা, আন্তর্জাতিক কর্মঘণ্টা ও প্রয়োজনীয় ছুটি তাদের কাছে এখনও সোনার হরিণ। মফস্বলের প্রিন্ট মিডিয়াগুলো ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের কথা চিন্তাই করেনা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাণী এক্ষেত্রে প্রায় নিস্ফল। ফলে দেশের বৃহত্তর অংশের মিডিয়া শ্রমিক বা মিডিয়া কর্মীরা রয়ে গেছে, মহান মে দিবসের তাৎপর্য হাওয়ার বাইরে।

বিশ্ব মানবতার বন্ধু হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বলেছেন ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার মজুরি দিয়ে দাও’ শাশ্বত সেই বাণী শ্রমিকের মর্যাদা দানে আরো উৎসাহিত করে যে ‘তারা (শ্রমিক) তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, তাই তোমরা যা খাবে তাদের তা খাওয়াবে, তোমরা যা পড়বে তাদের তা পড়তে দিবে’।

তাছাড়া মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মেষ চড়াতেন। খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের সময় নিজের কাঁধে পাথর বহন করে শ্রমের উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শ্রমিকদের প্রতি মর্যাদাবোধ ও অধিকার প্রদানে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মালিক শ্রেণিকে আরো কর্তব্য পরায়ন করে তুলেছেন মানবতার এই মহান বন্ধু। এমনকি অসংখ্য নবী এবং রাসুল আছেন যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। মালিক শ্রেণি ভাই হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির সুখ-দুঃখে অংশিদার হবে, বিপদে পাশে দাঁড়াবে ইসলামের নবী-রাসুলদের ইতিহাস এমন শিক্ষাই দেয়।

পরিশেষে বলা যায়, নানা আয়োজনে প্রতি বছর শ্রমিক দিবস পালন করার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণির প্রকৃত কোনো মুক্তি নেই। যে অধিকারের জন্য শ্রমিকরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন শিকাগোর রাজপথে, তা বাস্তবে এখনও অর্জিত হয়নি। আজও শ্রমিকরা পায়নি তাদের কাজের উন্নত পরিবেশ, পায়নি ভালোভাবে বেঁচে থাকার মতো মজুরি কাঠামো এবং স্বাভাবিক ও কাঙ্খিত জীবনের নিশ্চয়তা।

মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে শ্রমিক শ্রেণির প্রতি মালিক শ্রেণির সহনশীল মনোভাব থাকতে হবে। শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার আলোকে তাকে কাজ দিতে হবে। শ্রমিককে মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্য তার মজুরি সেভাবে নির্ধারণ করতে হবে। মালিককে অবশ্যই এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, তার নিজের স্বজনরা যে রকম জীবনযাপন করবে, তার অধীনস্থ শ্রমিকরাও সে রকম জীবনের নিশ্চয়তা পাবে। মালিক-শ্রমিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে শ্রমনীতি গ্রহন ও তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা গেলে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা আরও সমুন্নত হবে।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক, মোবাইলঃ ০১৭১৮-০৬৭২৬৩/ ০১৬১০-৭৭৭০৫৩, ই-মেইল: [email protected]