চৌধুরী আবদুল হান্নান


বিভিন্ন মানদন্ডে দেশ এগিয়েছে কিন্তু পিছিয়েছে ব্যাংকিং খাত। বর্তমানে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখনই লাগাম না টানলে পরিণাম হবে ভয়াবহ যা দেশের সকল অর্জন খেয়ে ফেলবে।

তবে বেড়ায় ক্ষেতের ফসল খেলে তা রক্ষা করা যায় না। অর্থ ভান্ডার রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের তারাই যদি অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার তালে থাকে তাহলে যা হবার তাই হবে।

ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনায় এবং নীতিমালার আলোকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ব্যাংক পরিচালা করেন। ব্যাংক ব্যবস্থার সর্বোচ্চ এই দুই স্তরে অসৎ ও অর্থলোভী লোকের অনুপ্রবেশ ঘটলে অর্থ বের করে নেওয়ার পথ খুলে যায়। ক্ষমতাবানরা টাকা একবার বের করে নিলে তা পরিশোধ করেন না, পরিশোধ না করলে কিছু হয় না। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির কাছে ব্যাংকগুলো অসহায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জনগণের জমাকৃত অর্থ এক শ্রেনীর লোক অবলীলায় ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে।

নতুন করে অপ্রয়োজনে আবার ২০১৩ সালে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছে সরকার। তাতে যত্রতত্র আমানতকারীদের অর্থ বিলিয়ে দেওয়ার এক ক্ষেত্র তৈয়ারী হওয়ার আশংকা রয়েছে।

নিকট অতীতে অদক্ষতা ও দুর্নীতর দায়ে দুইটি রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়েছে সরকার। ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ, কেলেংকারীর বোঝা মাথায় নিয়ে তারা বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু শীর্ষ পর্যায় থেকে অনিয়মিতভাবে বা জালিয়াতির মাধ্যেম অর্থ বের করে নেওয়ার প্রবনতা কমেনি।

সম্প্রতি এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যন ও এমডির বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৭শ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শোকজ করা হয়েছে (সমকাল ৩০ মার্চ)। শাখায় ঋণের আবেদন আসার আগেই ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মিতভাবে মঞ্জুর করেছে ফারমার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় (সমকাল ১৪ জানুয়ারী, ২০১৬)।

বেসরকারী খাতের একটি ব্যাংকের একজন পরিচালক একই ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন (সমকাল জুলাই, ২০১৪)। জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মো. ওযহিদুজামান ও একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে ৮০০ কোটি টাকার ওপর জুন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে (সমকাল ৬ জুন, ২০১৬)।
রুপালী ব্যাংকের পরামর্শক (বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবাহী পরিচালক) মো. আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে রুপালী ব্যাংক থেকে ভুয়া ঋণ অনুমোদন ও ছাড় করার ব্যবস্থা( কমিশনের বিনিময়ে) করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে (সমকাল ৬ জুন, ২০১৬)।

বেসরকারি মালিকানার ন্যাশনাল ব্যাংকের বোর্ড চেয়ারম্যান পরিচালকদের সহায়তায় ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মিতভাবে বের হয়েছে (সমকাল, ৬ নভেম্বর ২০১৪)।

ব্যাংক পরিচালকদের ক্ষমতা ব্যাপক, অপব্যবহার ও নজীর বিহীন। সরকারি ব্যাংকের বেশ কয়েকজন পরিচালক ক্ষমতার অপব্যাহার করে শাখা খুলতে গিয়ে নিজের বাড়ি ছাড়াও শ্বশুরবাড়ির এলাকায়ও শাখা খোলার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেখানে নামে বেনামে নিজস্ব লোকজন দিয়ে ঋণের নামে অর্থ বের করে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিডিবিএল ও রুপালী ব্যাংকে এ ধরনের ১৮ টি শাখা খোলার তথ্য পত্রিকায় এসেছ। সরকারি অন্যান্য ব্যাংক পরিচালকদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে। এ সকল শাখায় ক্ষমতাশালীদের ছত্রছায়ায় ব্যাপক ঋণ কেলেংকারী হওয়ার আশংকা রয়েছে। বিডিবিএল এর এমন একটি শাখা বি.বাড়িয়ার ‘আশুগঞ্জ শাখা’ সেখানে গুরুতর অনিয়ম ও জালিয়তির মাধ্যমে প্রায় ১১ কোটি (এগারো কোটি) টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট পরিচালকের কাছের লোকরা।

রূপালী ব্যাংকের সাবেক এক য়েয়ারম্যান এ বিষয়ে আরও এগিয়ে। তিনি গত কয়েকবছরে নিজের বাড়ি, শ্বশুরবড়ি ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এলাকায় এমন ৮টি শাখা খুলেছেন। এ সকল শাখা টাকা বের করে নেওয়ার এক একটি সুড়ঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

তারা নিজেরাও অর্থ বের করেছেন দেদার এবং ‘খালাতো ভাইদের’ ও বঞ্চিত করেননি। তাই তো দেখা যায় বিভিন্ন ব্যাংকরে ১০০ শীর্ষ জন খেলাপির আছে পাওনা রয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। কী নিবিড় সখ্যতা!

প্রতি বছর মুলধন যোগান দিয়ে রাষ্ট্র মালিকানার ব্যাংক গুলোকে টিকিয়ে রাখছে সরকার। কিন্তু পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। এভাবে দেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে দাড়িয়ে।

অনিয়ম, জালিয়াতির মাধ্যমে লুটে নেওয়া অর্থ কালো টাকা হিসেবে মুদ্রা ও পুঁজি বাজারে প্রবেশ করে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। দ্রব্যমূল্যে চাপ পড়ছে। জঙ্গী তৎপরতা, অস্ত্র, মাদক ইত্যাদি অবৈধ ব্যবসা গতিশীল হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ জ্বালা ভোগ করে চলেছে প্রতিটি নাগরিক।

ব্যাংকিং খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে এবং দুরবস্থার ক্রমাগত অবনতি রোধে ব্যাংকিং খাতের অবিভাবক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রনালয়ের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহনের বিকল্প নেই।

লেখকঃ অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক