নিউজ ডেস্ক : ষোলো শতাব্দীর ভবিষ্যদ্বক্তা নস্ট্রাডামুসের চেয়ে বিশ শতাব্দীর বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের ভবিষ্যদ্বাণীর দাম বেশি। বহুবার নস্ট্রাডামুসের নামে ‘কেয়ামত’-এর ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, বহুবার সেসব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ‘সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’-এর লেখক হকিং যখন বলেন, ‘বাঁচতে হলে মানুষকে ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী ছাড়তে হবে’; তখন কাণ্ডজ্ঞানওয়ালা মানুষ ভয় পাবেই। অবশ্য জনাব ট্রাম্পের কথা আলাদা, তিনি নিজেকে ছাড়া আর কিছুতে বিশ্বাস করেন না। আর কে জানে, ট্রাম্প সাহেবের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণেই হকিং সাহেব তাঁর আগের কথা থেকে সরে এসেছেন কি না। গত বছর তিনি জানিয়েছিলেন, আগামী এক হাজার বছরের মধ্যে পৃথিবী ধ্বংস হবে। ইতিমধ্যে ট্রাম্প সাহেব এসেছেন, হকিংয়ের ভবিষ্যদ্বাণীর মেয়াদ ৯০০ বছর কমে গেছে।

হকিং মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন, উল্কাঝড়ের আঘাত এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে মানুষকে ১০০ বছরের মধ্যে অন্য কোনো গ্রহে উপনিবেশ গাড়তে হবে। মানুষের আহাম্মকি ও লোভের কারণে এই বিপর্যয় ঘটবে বলে তাঁর ধারণা। প্রধানতম আহাম্মকি পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা, আর লোভের খেসারত পৃথিবী দিচ্ছে জলবায়ুর বারোটা বাজানোর মাধ্যমে।

পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কার কথাই ধরি। ক্ষমতায় এসেই ট্রাম্প পরমাণু শক্তিধর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলেছেন, দক্ষিণ চীন সাগরের একটি দ্বীপ নিয়ে চীনকেও হম্বিতম্বির মধ্যে রেখেছেন। গত মাসে তো উত্তর কোরিয়া বরাবর যুদ্ধজাহাজের বহরই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরে চীনের হুমকিতে তাঁর মতি ফেরে। যে পৃথিবীতে একই সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং-উন ক্ষমতায়, সে পৃথিবীর ভরসা কম। দুজনের হাতেই পরমাণু বোমার চাবি এবং একজন আমেরিকা, আরেকজন উত্তর কোরিয়ার মতো যুদ্ধংদেহী রাষ্ট্রের নেতা। এমতাবস্থায় ভয় না পাওয়াই বোকামি।

হকিংয়ের চোখে দ্বিতীয় প্রধান বিপদের কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন। প্যারিস চুক্তিতে বিশ্বকে উত্তপ্ত করার জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত মোকাবিলায় গরিব দেশগুলোকে অর্থসাহায্যের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। চীনের পর আমেরিকাই সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ। ট্রাম্প ওবামার কয়লাবিদ্যুৎ বর্জন এবং পরিষ্কার জ্বালানি ব্যবহারের পরিকল্পনাও বাতিল করবেন বলেছেন।

আসলে জলবায়ু পরিবর্তন কারণ নয়, তা হলো ফল। পৃথিবীর পানি-বাতাস-মাটি বিষিয়ে ফেলার ফল। মুনাফার জন্য হেন কাজ নেই যা পুঁজিবাদ করতে পারে না, বলেছিলেন মার্ক্স। জলবায়ু পরিবর্তন তাঁর কথাটা সত্য প্রমাণ করছে। পুঁজিবাদ বরং পৃথিবীকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করবে, তবু এই সর্বনাশা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বদলাবে না। এ ব্যবস্থা পৃথিবীর প্রকৃতি ও সম্পদকে শেষ পর্যন্ত নিংড়ে না নিয়ে থামবে না। পুঁজিবাদ যেহেতু নিজে থেকে বদলাবে না, তাই পৃথিবীটাই বদলে ফেলো, চাঁদে বা মঙ্গলে গিয়ে বসতি করো। হকিংয়ের কথায় এই তিক্ত সত্যটাই উঠে এল।

এখন উপায়? উপায় খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ল আরেকজন ভবিষ্যদ্বক্তার কথা। তিনি আমেরিকান সাম্রাজ্যের পতন দেখতে পেয়েছেন। গালতুংয়ের এ বিষয়ে বইয়ের নাম, ‘দ্য ফল অব দ্য আমেরিকান অ্যাম্পায়ার-অ্যান্ড দেন হোয়াট?’ (আমেরিকান সাম্রাজ্যের পতন এবং তারপর কী?) গত বছর নোবেল পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিলেন এই সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর নাম ইয়োহান গালতুং। নরওয়েজীয় এই অধ্যাপক শান্তি ও সংঘাত অধ্যয়নকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেন। তাঁকে জ্ঞানের এই শাখার জনকও বলা হয়। তাঁর অবদান বিস্তর। কিন্তু যে জন্য তিনি এখানে প্রাসঙ্গিক তা হলো, তিনি বিশ্বরাজনীতির অনেকগুলো মহাঘটনার নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ১৯৮০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন; তাঁর সময়সীমার দুই মাস আগেই ঘটনাটি ঘটে যায়। ১৯৭৮ সালের ইরান বিপ্লব, ১৯৮৯-এ চীনের তিয়েনআনমেন চত্বরের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৮৭, ২০০৮ ও ২০১১ সালের তিনটি অর্থনৈতিক সংকট, এমনকি ৯/১১-এর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণীও নিখুঁত যথার্থতায় করেছিলেন তিনি।

গালতুং অনেকগুলো জ্ঞানশাস্ত্র মিলিয়ে দ্বন্দ্ব-সংকটের বিশ্লেষণ থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পদ্ধতিটা বের করেছেন। এহেন মারাত্মক ব্যক্তি ২০০০ সালে বলেছিলেন, ২৫ বছরের মধ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যের পতন ঘটবে। প্রেসিডেন্ট বুশ নির্বাচিত হওয়ার পর পতনবিন্দু পাঁচ বছর এগিয়ে করেন ২০২০ সাল। বুশের চরম যুদ্ধবাজ আচরণ পতনকে ত্বরান্বিত করছে বলে তিনি মনে করেন। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর ভাবনা হলো, ইনিও পতনকে এগিয়ে আনছেন। অবশ্য সতর্ক বৈজ্ঞানিক শর্ত যোগ করে বলেছেন, চূড়ান্ত রায় দেওয়ার আগে দেখতে চান, বাস্তবে এই ধনকুবের কী করেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির ১০০ দিন গেছে। তিনি তাঁর বিপর্যয়কর গতিপথ এখনো ছাড়েননি। ছাড়বেন বলেও মনে হচ্ছে না।

পতনের আগে আমেরিকা সংক্ষিপ্ত ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্যে দিয়ে যাবে বলে তাঁর বিশ্বাস। সোভিয়েত ইউনিয়নের বেলায় তিনি পাঁচটি মৌলিক দ্বন্দ্ব চিহ্নিত করেছিলেন, আমেরিকার বেলায় করেছেন ১৫টি। ইতিমধ্যে অনেক লক্ষণ মিলে যাচ্ছে, নতুন শতকের অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র সরে এসেছে এশিয়ায় আর তার মধ্যমণি হিসেবে বসে আছে চীন। আমেরিকার মিলিটারি ও টাকা আছে, আর চীনের আছে টাকা ও মিলিটারি। তবে বৈশ্বিক স্তরে পতিত আমেরিকা ধ্বংস হবে না, ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াবে আরও গণতান্ত্রিক এক আমেরিকান প্রজাতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রীয় মডেলের বদলে তা হবে, কনফেডারেশন।

দুনিয়ার বহু বিপ্লবী, জাতীয়তাবাদী, জিহাদি, শান্তিবাদী এবং জ্ঞানী ও মূর্খ গোছের মানুষ আমেরিকার পতন কামনা করে আসছেন। রাজপথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিপাত যাওয়ার স্লোগান ওঠেনি, এমন দেশ পাওয়া বিরল। কিন্তু গালতুংয়ের ‘সাম্রাজ্যের পতন’ মানবিক যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখায়। তা যদি হয়, তাহলে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি কমে যাওয়ার কথা, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলোও দুর্বল হওয়ার কথা। যুদ্ধের থাবায় মানুষ আর ভোগবাদের গ্রাস থেকে পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা পাওয়ার কথা। কিন্তু সে আশার গুড়ে সম্ভবত প্রচুর পরিমাণ বালি মেশানো। যে চীনা শতাব্দী আসছে, সেই চীনের যুদ্ধক্ষমতা, মুনাফার লোভ এবং পরিবেশ-বৈরী ব্যবসা কম ধ্বংসাত্মক নয়। চীনা পুঁজিবাদ মোটেও মানবিক হবে না। এখনো হয়তো তা পেশি দেখায়নি, কিন্তু আমেরিকার শূন্যতা তা দ্রুত পূরণ করতে চাইবে। তার জন্য যুদ্ধ বাধাতে যাবে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের তথা রাশিয়া কিংবা ভারতের সঙ্গে।

তাই হকিংয়ের নিরাশাবাদের পাল্লাই ভারি বলে দেখা যায়। তারপরও শেষ কথা মানুষ। মানুষ হলো ইতিহাসের ক্যালকুলাসের সেই ‘এক্স’ ফ্যাক্টর, যাকে ছাড়া কোনো অঙ্কই মিলবার নয়। সম্মিলিত মানুষ, যার কথা জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় এভাবে বলেছিলেন, ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব রয়ে যায়।’ সেই মানুষ শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক প্রাণী। তাই এই কবির মনে হয়েছিল, ‘কেমন আশার মতো মনে হয় রোদের পৃথিবী।’ এই মানুষের বৈশ্বিক উত্থানও পৃথিবী দেখেছে আরব বসন্তে, অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনে, প্যারিসের গরিব কৃষ্ণকায় তরুণদের গণ-অভ্যুত্থানে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মার্কিন জনতার মিছিলও আশা জাগিয়েছিল।

পৃথিবীর রাজনীতি পেন্ডুলামের মতো দোলে। একবার অতি ডানের ধ্বংস-হাতে পড়ার পর পৃথিবী বাঁ দিকে মোড় নিয়ে বাঁচে। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একের পর এক দেশ বিপ্লবী হয়েছিল, স্বাধীন হয়েছিল, মুক্তিকামী হয়েছিল। হয়তো এত এত যুদ্ধ-হত্যা-রিরংসা পার হয়ে আমরাও পৌঁছাব কোনো নবীনতর ভোরে। ব্যক্তিমানুষ আত্মহত্যা করে, কিন্তু প্রজাতিগতভাবে আত্মহত্যা করতে অক্ষম সৃষ্টির যেকোনো প্রাণী। আর মানুষ তো উন্নততর প্রাণী। প্রজাতিগত সুরক্ষার চেতনা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই মানুষের ওপর বিশ্বাস রেখে কাজ করে যাওয়া ছাড়া উপায় আর নেই।

(ওএস/এএস/মে ০৮, ২০১৭)