প্রবীর সিকদার


গত ৯ মে ভোর রাতে ফরিদপুরে মো. সবুজউদ্দিন ও পাভেল মুন্সী নামের দুই তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়ে হয়ে মারা গেছেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই দুই তরুণের রহস্যে ঘেরা মৃত্যু নিয়ে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা সাংবাদিকদের বলেছেন, দুই দল ডাকাতের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনায় দুই জন নিহত হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাদেরকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত বলে ঘোষণা করেন।

পুলিশ সুপারের বর্ণনা নিখুঁত। সব বন্দুক যুদ্ধ ও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার বর্ণনা এমনই হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এমন বর্ণনাকে মেনে নিয়েই স্বজনরা লাশ নিয়ে যান। ফরিদপুরের পুলিশ সুপারের বর্ণনাতেও তেমন প্রতিক্রিয়া হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু সমস্যা বাঁধালেন নিহত এক তরুণ মো. সবুজউদ্দিনের মা সাজেদা বেগম। সাজেদা বেগমের অভিযোগ, তার ছেলে সবুজকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার স্পষ্ট অভিযোগের তীর ফরিদপুর পুলিশের দিকেই। সাজেদা বেগম গত ১৫ মে এই সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগপত্র ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছেন।আর ওই পত্রটিই ফরিদপুরের পুলিশ সুপারের দেওয়া দুই তরুণের মৃত্যুর বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

ফরিদপুরে সংঘটিত নানা ঘটনা খুব একটা প্রমাণ করে না যে, সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষ সন্তুষ্ট। তবে এটা ঠিক যে, জেলার একটি প্রভাবশালী চক্র দারুণ সন্তুষ্ট ফরিদপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। তাদের যেমনটি চাওয়া তেমনটি হলে তো আর অসন্তুষ্ট হবার কোনো কারণও থাকে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন। প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানালে নানা মামলায় জড়িয়ে ভোগান্তিতে ফেলতে পারেন 'সন্তুষ্ট চক্র', এই ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। সবাই 'ভাই ভাই জিন্দাবাদ' দিয়ে নিরাপদে থাকতে চান।

অন্ধ হলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না! একটার পর একটা অঘটন ঘটে। পুলিশ ঘটনার চেয়ে ভাইজান কিংবা তাদের চ্যালাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, উনারা কি বলেন! আর সেইভাবেই সবকিছু চলে 'খুব ভালভাবেই'! কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের কষ্টটা আরও অনেক কষ্টের নিচে চাপা পড়ে যায়।

সাম্প্রতিক সময়কালে ফরিদপুর শহরতলীর বদরপুরে ৪ জনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে একটি দুর্বৃত্ত চক্র। ওই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে মাদক ব্যবসার ভাগ বাটোয়ারার কথা শোনা গেলেও পুলিশ বলেছে , ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে মারা গেছেন ওই ৪ জন। বেশ ওই পর্যন্তই। পুলিশ ওই ঘটনার কোনো তদন্তই করেনি। একই সাথে চার চার জন মানুষ খুন, অথচ ওই ঘটনার কোনো তদন্ত ও মামলা নেই! এই তো সেদিনের কথা, ফরিদপুর শহরে ভোররাতে কর্মরত অবস্থায় খুন হলেন দুই জন সুইপার। সেই ঘটনার পুলিশি কোনো তদন্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থার কথা জানে না কেউ। বিয়ের পর পরই ফরিদপুর শহরে খুন হলেন এক মেধাবী ছাত্রী রোদেলা। পুলিশি কোনো উদ্যোগের কথা জানে না কেউ! ঘাতক স্বামী সোহান সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় বিদেশে। সেই ঘটনায় পুলিশি তদন্ত হিমাগারে! মাদক ব্যবসা ও পরিবহন চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধে শহরের রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় ছোটন বিশ্বাসকে। সেই হত্যাকাণ্ডেরও পুলিশি তদন্তের ফলাফল শূন্য।

সাম্প্রতিক কালেই ফরিদপুর শহরে হত্যার উদ্দেশ্যে নৃশংস হামলার শিকার হয়েছেন পৃথক পৃথকভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী, মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার ও প্রবীন আওয়ামীলীগ নেতা নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল, ফরিদপুর জেলা আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট বদিউজ্জামান বাবুল, ফরিদপুর জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলক সেন, ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শওকত আলী জাহিদ প্রমুখ। এদের সকলকেই হত্যার উদ্দেশ্যে ধারালো চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়। ওদের সকলের ওপর হামলার ধরণ,কারণ ও হামলাকারী অভিন্ন। সব হামলার নেপথ্যের ইন্ধনদাতারাও অভিন্ন। ওই সব হামলায় সরাসরি জড়িত পাঠা সোহাগের নাম মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হলেও পুলিশ তাকিয়ে থাকে ভাইজানদের দিকে। সকল ক্ষেত্রে যা হবার তাই হয়েছে, বহুল আলোচিত ওই সব নৃশংস হামলার তদন্ত ও মামলা নিয়ে কোনই মাথা ব্যথা নেই ফরিদপুর পুলিশের।

এইভাবেই সময় গড়িয়েছে অনেক। সেই ফরিদপুর পুলিশের বিরুদ্ধেই সরাসরি সন্তান হত্যার অভিযোগ করেছেন এক মা সাজেদা বেগম। সাজেদা বেগমের স্বামী নির্মোহ এক জাসদ নেতা সেখ আশরাফ উদ্দিন তারা। তাদের বাড়ি ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকার মোল্লা বাড়ি সড়কে। সাজেদা বেগম ও আশরাফ উদ্দিন তারার দাবি, গত ৮ মে ফরিদপুর পুলিশ তাদের সন্তান সবুজকে তুলে নিয়ে যায়। এব্যাপারে ওই দিনই ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় যোগাযোগ করা হলে সবুজকে আটকের কথা অস্বীকার করে পুলিশ। পরদিন ভোরে নুরু মিয়া বাইপাস সড়কে আর এক তরুণের লাশের সাথে পাওয়া যায় সবুজের লাশ।

সন্তান হারা সাজেদা বেগম ও সেখ আশরাফ উদ্দিনের তীব্র যন্ত্রনাদগ্ধ অভিযোগ, সবুজকে হত্যা করেছে পুলিশ। যদিও ফরিদপুরের পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা সেই অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথাগত বন্দুক যুদ্ধের কথাই বলেছেন। পুলিশ সুপারের কথায় কোনো গুরুত্ব দেননি সবুজের বাবা-মা। তারা গুরুতর এই অভিযোগটি করেছেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছেই।

প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসবে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে। কিন্তু ফরিদপুরে সাম্প্রতিককালে পুলিশের তৎপরতা যে সন্তোষজনক নয়, সেটা অনেক অঘটনের কিছু কিছু চিত্রে বেশ স্পষ্ট। সাধারণ মানুষ যে ফরিদপুর পুলিশের তৎপরতায় ক্ষুব্ধ-বিরক্ত সেটাও বেশ পরিষ্কার। এরই মধ্যে সবুজের অস্বাভাবিক মৃত্যু ফরিদপুর পুলিশকে দারুণ এক অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। মানুষও দীর্ঘ আতঙ্ক কাটিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছে। সবুজের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ পেশ সেই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আমি বিশ্বাস করি, স্বজনহারাদের যন্ত্রণার কথা দারুণ উপলব্ধি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফরিদপুর পুলিশের বিরুদ্ধে মায়ের উত্থাপিত সন্তান খুনের অভিযোগটি গুরুত্বের সাথে তদন্তের ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রী করবেনই। তদন্তে যারা দোষী প্রমাণিত হবেন তারা যে সাজা এড়াতে পারবেন না, সেটা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলা ও রায়ে প্রতিফলিত। সবশেষে আমি স্যালুট জানাই সবুজের মা সাজেদা বেগমকে, যিনি সাহস করে গুরুতর অভিযোগটি করেছেন ফরিদপুরে থেকেই এবং অভিযোগটিও করেছেন আমাদের সকলের ভরসাকেন্দ্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেই; আইন যে সবার জন্য সমান,সেটা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এই দেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন শুধুই শেখ হাসিনা।

(ওএস/অ/মে ১৭, ২০১৭)