প্রবীর সিকদার


নারায়ণগঞ্জের বিএনপি নেতা আবুল বাশার কাশু কিংবা ফরিদপুরের বিএনপি ক্যাডার সাজ্জাদ হোসেন বরকত ওরফে বরকত মণ্ডল ওরফে চৌধুরী বরকত ইবনে সালাম, বহুল আলোচিত দুই নাম। দুইজনের বিরুদ্ধেই খুনের অভিযোগ রয়েছে। বাশার কাশু নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত ৪ খুনের মামলার আসামী। তিনি বিচার ও শাস্তি থেকে বাঁচতে আওয়ামীলীগে যোগ দিয়েছেন। যদিও বাশার বিচার এড়াতে পারেননি; তিনিসহ ২৩ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। অপরজন বরকত মণ্ডল ওরফে চৌধুরী বরকত ইবনে সালাম আওয়ামীলীগে যোগ দিয়ে শুধু হত্যা মামলাই চাপা দেননি, বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে ফরিদপুর আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে অঘোষিত নিয়ন্ত্রক হয়েছেন। এই দুইজনেরই উত্থান একই রকমের। আবুল বাশার কাশু নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের এমপি নজরুল ইসলাম বাবুকে ও বরকত মণ্ডল ওরফে চৌধুরী বরকত ইবনে সালাম ফরিদপুর-৩ আসনের এমপি, এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে ম্যানেজ করে আওয়ামীলীগে নাম লিখিয়েছেন। এই দুই ঘটনাতেই দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের মতামতের তোয়াক্কা করা হয়নি কিংবা কেউ প্রকাশ্যে হাইব্রিড অনুপ্রবেশে আপত্তি জানাতে পারেননি।আওয়ামীলীগের ভাবমূর্তি বিনাশে এই দুটি ঘটনা কম দায়ী নয়।

নারায়ণগঞ্জ। বিএনপি-জামায়াতের প্রতিহিংসার রাজনীতির নির্মম বলী হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে চার আওয়ামীলীগ কর্মী বারেক,বাদল, ফারুক ও কবীর। ২০০২ সালের ১২ মার্চ এদেরকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর আগুনে পুড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন গোপালদী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবুল বাশার কাশু ও তার নেতৃত্বের একদল বর্বর বিএনপি ক্যাডার। নৃশংস ওই ঘটনার বিচার চলাকালে ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলার গোপালদী বাজারে এক বর্ণাঢ্য সমাবেশে নারায়ণগঞ্জ- ২ আসন তথা আড়াইহাজারের এমপি নজরুল ইসলাম বাবুকে ফুলের তোড়া ও তিন ভরি ওজনের স্বর্ণের একটি নৌকা প্রতীক উপহার দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন আওয়ামীলীগেরই চার কর্মী খুনের চাঞ্চল্যকর মামলার চার্জশিটের তিন প্রধান আসামী আবুল বাশার কাশু, বদরুদ্দিন আহম্মেদ, জহিরুল হকসহ বিএনপির হাজারো নেতা-কর্মী। সেদিনের ওই যোগদান অনুষ্ঠান নিয়ে দারুণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন নির্মম খুনের শিকার চার আওয়ামীলীগ কর্মীর পরিবার ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের অনেক নেতাকর্মী। কিন্তু এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ভয়ে কেউ টু শব্দটি করতে পারেননি।

গত ১৭ মে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কামরুন নাহারের আদালত চাঞ্চল্যকর আওয়ামীলীগের ৪ কর্মী খুনের মামলায় আওয়ামীলীগে যোগ দেওয়া সাবেক বিএনপি নেতা আবুল বাশার কাশুসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। এই রায়ে নারায়ণগঞ্জে স্বস্তির সুবাতাস বইলেও অস্বস্তিতে পড়েছে সেখানকার আওয়ামীলীগ। এখন আওয়ামীলীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের অভিন্ন বিস্ময়, ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামী আবুল বাশার কাশু ও তার সহযোগী দুর্বৃত্তদের দায় আওয়ামীলীগ নেবে কেন! এখন ঠেলা সামলান এমপি সাহেব! এমন বহু নজির আছে নারায়ণগঞ্জ জেলা জুড়েই।

এবার আসি নারায়ণগঞ্জ থেকে ফরিদপুরে। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে খুন হন ফরিদপুর পৌর আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক এডভোকেট এএইচএম মহিউদ্দীন খোকন। নৃশংস এই মৃত্যুর খবর পেয়ে ফরিদপুরে ছুটে গিয়েছিলেন আওয়ামীলীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সেদিন খোকনের কবরে ফুল দিয়ে চোখের জলও ফেলেছিলেন শেখ হাসিনা। ওই খুনের মামলার অন্যতম আসামী ছিলেন সেই দিনের দুর্ধর্ষ বিএনপি ক্যাডার বরকত মণ্ডল ওরফে চৌধুরী বরকত ইবনে সালাম। ফরিদপুর-৩ আসনের এমপি তথা বর্তমান সরকারের এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের হাত ধরে এডভোকেট খোকনের সেই খুনি বরকত ওরফে চৌধুরী বরকত ইবনে সালাম এখন ফরিদপুরে আওয়ামীলীগের রাজনীতির অনেকটাই নিয়ন্ত্রক। অন্ধকারের নানা কামাই রোজগারের একটি অংশ ঘাটে ঘাটে ছড়িয়ে ফরিদপুর শহর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তিনি। একই কায়দায় তিনি বাগিয়ে নিয়েছিলেন ফরিদপুর শহর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়কের পদটিও।জেলার মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে তার আপন ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলকে দিয়ে জোরজবরদস্তি করে দখল করিয়েছিলেন ঐতিহ্যবাহী ফরিদপুর প্রেসক্লাব। অসাংবাদিক রুবেল এখন ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি। জেলা জুড়ে টাকার খনি হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর বাস মালিক সমিতির সভাপতিও হয়েছেন বরকত, সেখানেও আশীর্বাদ মন্ত্রীরই।

ফরিদপুরে কোনও টেন্ডার কাজের শিডিউল সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাওয়া যায় না; পাওয়া যায় হাল আমলের ওই প্রতাপশালী আওয়ামীলীগ নেতা বরকতের নিজস্ব অফিসে। সেখানেই টেন্ডার শিডিউল বিক্রি হয়। পরে দেখা যায়, টেন্ডার শিডিউল ২৫ বা ৫০, যে কয়টিই বিক্রি হয়েছে, জমা পড়েছে মাত্র ৩ টি। সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে মাত্র ওই ৩ টি শিডিউল বিক্রির টাকা। আর সব টাকা গায়েব! টেন্ডার কাজ যিনিই পান বা যার লাইসেন্সের অনুকূলেই বরাদ্দ হোক, কাজটির মোট মূল্যের ১৬% অগ্রিম টাকা বিশেষ পকেটে না ঢোকা পর্যন্ত ওয়ার্ক অর্ডার কারো ভাগ্যেই জোটে না। ফাইনাল বিলের সময় আদায় করা আরো ৬% টাকা। উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া বা ফেঁসে যাওয়া ফরিদপুর শহরে বেশ কয়েকটি সরকারি মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি দৃষ্টিনন্দন সরকারি পুকুর ভরাট করেও মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে অনৈতিক বাণিজ্যের ধান্ধায়। এই সবই নিয়ন্ত্রণ করেন ওই বরকত।

শুধু বিএনপি ক্যাডার নয় বরকত; ফরিদপুরের দুর্ধর্ষ রাজাকার জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারের আপন ভাগ্নে এই বরকত! যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে বরকত তার মামা ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী খোকন রাজাকারকে দেশত্যাগের নিরাপদ ব্যবস্থা করে দেয়। পরে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেন।

এই বরকতকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা মন্ত্রীর আস্থাভাজন হয়ে ফরিদপুরের স্থানীয় আওয়ামীলীগে হাইব্রিড উৎপাত চালাচ্ছে।সেই হাইব্রিড উৎপাতে অতিষ্ঠ আওয়ামীলীগের নিবেদিত প্রাণ নেতা কর্মী সমর্থকেরা। এই উৎপাতের নিরসন দূরে থাকুক, নিবেদিত প্রাণ ওই আওয়ামীলীগারদের কষ্ট-যন্ত্রণার কথা শোনারও কেউ নেই কোথাও। অবশ্য সবাই বুঝতে পারছেন, বরকতের নেতৃত্বের হাইব্রিড উৎপাতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।ওই নির্বাচনে বরকত চক্র বুকে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ এঁটে ভোট সংগ্রহ করবে ধানের শীষের। আওয়ামীলীগ দুর্দিনে পড়লে ওরা ঠিক ঠিক ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবে, বিএনপি-জামায়াতের আস্তানায়। এই যখন নির্মম বাস্তবতা, তাহলে বরকতের দায় কেন নিচ্ছে আওয়ামীলীগ! এই বিস্ময় শুধু আওয়ামী শিবিরেই নয়, আওয়ামীলীগ বিরোধীরা বিস্মিত!

নারায়ণগঞ্জ ও ফরিদপুরের এই দুই ঘটনা জানান দিচ্ছে ,বাশার ও বরকতেরা শুধু নারায়ণগঞ্জ কিংবা ফরিদপুরে নয়, সারাদেশেই ভিন্ন ভিন্ন নামে বাশার-বরকতেরা হাইব্রিড উৎপাত চালিয়ে আওয়ামীলীগকে পর্যুদস্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার মিশনে নেমেছে। এখনই কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ ও তার সরকার বাশার কিংবা বরকরত এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামী সংসদ নির্বাচনে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আমি অবশ্য এখনো বিশ্বাস করি, যে দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, তিনি অবশ্যই বাশার কিংবা বরকতদের হাইব্রিড উৎপাত এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের অপতৎপরতা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তিনি যথোপযুক্ত সময়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীলীগ ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন এবং দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাবেন।

(পিএস/এএস/মে ২০, ২০১৭)