মো. আশিকুল ইসলাম চয়ন : প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেট ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাজেট ইতিহাসের যে যাত্রা শুরু হয়েছে তাতে বর্তমান ২০১৪-২০১৫ইং অর্থবছরের বাজেট ৪৩তম বাজেট হিসাবে সংযুক্ত হয়েছে। নানান জল্পনা কল্পনার অবসানের পর কোন রকম নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাই এসে মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট ঘোষিত হল। জনাব আবুল মাল আব্দুল মুহিত অষ্টমবারের মত বাজেট ঘোষণা করলেন।

এবারের বাজেট আমাদের দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ যা টাকার অংকে ২,৫০,৫০৬ কোটি টাকা। মোট আদায় ধরা হয়েছে ১,৮৯,৩৪৬ কোটি টাকা।আর ঘাটতি ধরা হয়েছে ৬১,৩৪৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ শতাংশ। এই বিশাল বাজেটের অর্থ যোগান হবে আয়কর ও মুনাফা খাত থেকে ৫৬,০৮৬ কোটি, মূল্য সংযোজন কর থেকে ৫৫,০১৩ কোটি, আমদানি শুল্ক থেকে ১৪,৫৯০ কোটি, সম্পুরক শুল্ক থেকে ২১,৩৩৪ কোটি,এনবিআরের অন্যান্য আদায় থেকে ২,৬৯৭ কোটি এনবিআরের বাহিরের কর থেকে ৫,৫৭২ কোটি, কর ব্যাতিত রাজস্ব থেকে ২৭,৬৬২ কোটি ও বিদেশী অনুদান থেকে ৬,২০৬ কোটি টাকা।আর এই অর্থ অনুন্নয়ন রাজস্ব ব্যয়ে ১,২৮,২৩১ কোটি, অনুন্নয়ন মূলধন ব্যয়ে ২৬,০১০ কোটি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি(এডিপি) ৮০,৩১৫ কোটি,এডিপি বহির্ভূত ব্যয়ে ৩,৪৬৯ কোটি, খাদ্য ৩০৯, ঋণ ও অগ্রিম ৯,৬১১ কোটি ও অন্যান্য ব্যয়ে ২,৫৬১ কোটি টাকা। বর্তমান বাজেটে গত বাজেটের তুলনায় জন প্রশাসনে ৪২% , সামাজিক নিরাপত্তা ও ত্রাণ খাতে ২৩% ,জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ১৭%, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১৬% বৃদ্ধি করা হয়েছে । প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৩%। এই বাজেটের ঘাটতি মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৪৩,২৭৭ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। যার মধ্যে ব্যাংক থেকে ৩১,২২১ কোটি ও বৈদেশিক উৎস থেকে ১৮,৬৯ কোটি টাকা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু এই বিশাল অংকের টাকা যদি আমাদের ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় তাহলে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় যে অর্থ লাগবে তা ব্যাংকের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে না। এতে আমাদের ব্যবসায়ীরা চরম সমস্যার সম্মুখীন হবে ।কিন্তু এই সমস্যা সরকার ইচ্ছা করলেই মেটাতে পারবে, যদি বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করে, কেননা আমাদের সরকার ঋণ খেলাফি নয়। এই বাজেট কে অনেকেই উচ্চবিলাসি বলছে আবার কেও বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দেখছে না। কিন্তু এই বাজেটের অনেক ভালো দিক আছে। হয়তো প্রবৃদ্ধি ৭.৩% অর্জিত হবে না, কেননা বিগত তিন বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ৬.১২% অর্জিত হয়েছে। যদিও এর কারণ হোল বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান হ্রাস । যদি আমরা বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে পারি তাহলে প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে। আর এর জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জমির ব্যবস্থা করতে হবে।প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে রেমিটেন্সও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক,যা বর্তমানে ঋণাত্মক অবস্থানে আছে। এই বিষয় গুলোর প্রতি যত্নবান না হলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করা যাবে না।এবারে কৃষি খাতে বরাদ্দ বারে নাই। তাই এর প্রভাব কৃষিতে পরতে পারে। জন প্রশাসনে ৪২% বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বলে মনে করি। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১৬% বৃদ্ধি করা হয়েছে যাতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তারপরও আরও অধিক অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যেত। যোগাযোগ ও পরিবহণ খাত কে গুরুত্ব দেওয়া বিশেষ করে পদ্মা সেতুতে ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া একটি সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করি।এবারের বাজেট শিল্প বান্ধব । পস্তাবিত ১৪/২০১৫ অর্থবছরের বাজেট রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করার লক্ষে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তার উপর উৎসে কর কর্তনের হার ৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করা, পোশাক শিল্পে অগ্রিম আয়কর শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ করা, পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের দক্ষতার বৃদ্ধির জন্য ৫০ কোটি টাকার তহবিল বরাদ্দ ও শিল্পের বিকেন্দ্রি করণের জন্য সহায়ক নীতিমালা ঘোষণা এই খাতের জন্য ইতিবাচক। এছাড়াও অনগ্রসর এলাকায় শিল্প স্থাপন ও স্থান্তরের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ কর রেয়াতের সুবিধা শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পোশাক শিল্পের নিরাপত্তার স্বার্থে স্টিলের ভবন ও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আমদানিতে শুল্ক মুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি পোশাক শিল্পের বিদ্যমান জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার জটিলতা নিরসনে ভূমিকা রাখবে। বাজেটে শিল্প খাতের কর অবকাশ সুবিধা ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো একটি ভালো সিদ্ধান্ত। শেয়ার বাজার কে চাঙ্গা করতে স্টক একচেঞ্জের ডিমিউচুলাইজেশনের ক্ষেত্রে আগামী অর্থবছর থেকে পাঁচ বছরের জন্য কর রেয়াত এবং লভ্যাংশ আয়ের উপর কর রেয়াতের সীমা ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকাই বর্ধিত করা ইতিবাচক সিদ্দান্ত। জাহাজ শিল্প এদেশের একটি বিকাশমান শিল্প ,তাই এই শিল্পের সম্ভাবনা বিবেচনা করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক হার ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখাও একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এছাড়া ওষুধ শিল্পের বিকাশ ধরে রাখার জন্য ৪০ ধরণের মৌলিক কাঁচামালের উপর শুল্ক ১০ ও ১৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৫% রেয়াতি হারে ধার্য করা ও আয়ুর্বেদিক ওষুধশিল্পের ৪১ ধরণের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে ৫% করা এবং ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামালের শুল্ক হার প্রত্যাহার করাও একটি ভালো দিক। বিশেষ করে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য পরিশোধনের যন্ত্রপাতি স্থাপনে ব্যর্থ হবে তাদের ওপর ১% হারে অধিক শিল্প আরোপের প্রস্তাব একটি জরুরী সিদ্ধান্ত, যা সবুজ শিল্প প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

এই বাজেটের অনেক ভালো দিক আছে, কিন্তু এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নির্ভর করবে দুর্নীতি মুক্ত সুশাসন ও রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর। বড় ধরণের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে গেলে বড় ধরণের বাজেটের অবশ্যই প্রয়োজন । জনগণের দোরগোড়ায় বাজেটের সুফল পৌছালো কিনা তার খেয়াল রাখাতে হবে। মহান সংসদে মাননীয় সাংসদগণ বাজেটের ওপর গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ প্রদান করেন, কিন্তু অধিক সময় মাননীয় অর্থমন্ত্রী ব্যস্ততার দরুন সংসদে উপস্থিত থাকতে পারেন না। তাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা অথবা সাংসদের কে দিয়ে একটি কমিটি করলে, তারা মাননীয় সাংসদগণের উত্থাপিত সুপারিশ গুলো সংরক্ষণ করে সংশোধিত বাজেট প্রণয়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেন। বাজেটে অনেক গুলো চ্যালেঞ্জ আছে, ঘারতি মোকাবেলা নিয়ে প্রশ্ন আছে, বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় আছে, কিন্তু সরকার ইচ্ছা করলেই এই সংশয়ের বাজেট কে সম্ভাবনার বাজেটে রূপান্তরিত করতে পারে। আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় এই বাংলাদেশ কে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে অবশ্যই বাজেটের বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেট কে সংশয়ের বাজেট নয় সম্ভাবনার বাজেট হিসেবে দেখতে চাই। আর আমরা জনগণ সেই প্রত্যাশাই অপেক্ষাই আছি।

লেখক : নিবন্ধক ও আহব্বায়ক, দ্যা ফোরাম অব নিউ ভোটরস।