মো. আমির হোসাইন


১৯২০ এ থল যুদ্ধে বৃটিশদের হটিয়ে বাদশাহ আমানুল্লার নেতৃত্বে আফগানস্থান স্বাধীন হয়। আমানুল্লা ছিলেন সংস্কারমুক্ত, বিজ্ঞান মনস্ক, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। বৃটিশরা যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আফগানস্থানের এই জাতীয়তাবাদী নেতাকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। তাঁরা আফগানস্থানের একদিকে উপজাতীয় ধর্মান্ধ ধর্মীয় নেতাদের ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলেন।

বাদশাহ আমানুল্লার ব্যক্তিগত চরিত্রের কোন দোষ আবিষ্কার করতে না পেরে বৃটিশ গোয়েন্দাবিভাগ তাঁর স্ত্রী সুরাইয়াকে আক্রমণের টার্গেট করেছিল। সুরাইয়া আধুনিকা রানী। পর্দাপ্রথা মানেন না। স্বামীর সঙ্গে ইউরোপ সফরে এসে তিনি বোরখায় মুখ না ঢেকে চলাফেরা করেছেন। সেই ছবি তুলে নিয়ে ইংরেজ লরেন্স আফগানস্থানের অশিক্ষিত মোল্লাদের মধ্যে বিতরণ করেন এবং ধর্মের নামে তাদের ক্ষেপিয়ে তোলেন। তুরস্কের কামাল পাশা বাদশা আমানুল্লাকে একবার বলেছিলেন; ‘ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে আপনি যেমন ভয় পাননি, জাতিকে বিজ্ঞান সভ্যতার আলোক দান করার ব্যাপারে তেমনি কোন প্রতিবন্ধকতার কাছে আপনি মাথানত করবেন না।’ কিন্তু ইতিহাসের সত্য সকল সময় নির্মম ও কঠিন। বর্তমান অন্ধকার আফগানস্থানকে দেখে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় এই আফগানস্থান একসময়ে আমানুল্লার নেতৃত্বে বিশ্বের আধুনিক রাষ্ট্রের কাতারে দাঁড়িয়ে ছিল। ধর্মান্ধ মোল্লারা এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমানুল্লাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আমানুল্লা ইতালিতে আশ্রয় নেন, এবং সেখানেই মৃত্যবরণ করেন। আফগানস্থান আজো গোঁড়ামির অন্ধত্বে নিমজ্জিত।

আওয়ামীলীগ ভারতের তাঁবেদার সরকার। হিন্দুদের দালাল সরকার। এই দেশের মসজিদে মসজিদে আজান নয় উলুধ্বনি দেওয়া হয়। ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এমন প্রচারই করা হয়েছে বিশ্বময়। আওয়ামীলীগ ও বঙ্গবন্ধুর আমলে এই প্রচারযন্ত্রের কৌশল তারও আগের। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। ধর্মীয় এই অপপ্রচারের পাশাপাশি ছিল প্রতি বিপ্লবীদের দিয়ে যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে হত্যা, লুটপাট ও বিশৃঙ্খলা তৈরী। আওয়ামীলীগের ভেতরেও তৈরি করা হয়েছিল অস্থিরতা। চোর বাটপার আর দুর্ণীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘আমার ডানে চোর, বামে চোর, সামনে চোর, পেছনেও চোর। দেশ স্বাধীন করলে সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেলাম চোরের খনি। আমি বিদেশ থেকে যা কিছু আনি এ চাটার দল খাইয়া ফালায়।’ নিজ দলের এমন সমালোচনা আর কোন দেশের কোন রাষ্ট্রপ্রধান করেছিলেন কিনা তাঁর প্রমাণ দেওয়া হবে দুর্লভ। দলের ভেতরের চোর বাটপার ও দলের বাইরের সিআইএর দালাল প্রতিবিপ্লবীদের দ্বিমুখী ষড়যন্ত্রে স্ব-পরিবারে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে গ্রামের ঘরে ঘরে মোল্লারা গিয়ে কোরআন শরীফ বিতরণ করে ভোটারদের বলে এসেছিল, আওয়ামীলীগকে ভোট দেওয়া জাহান্নামের টিকেট কাটার সমান। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি দেওয়া হবে। ২০১৩ সালে আওয়ামীলীগকে ভারতের দালাল সরকার বলার পাশাপাশি নতুন আরো একটি প্রচার করা হতে থাকল, এই সরকার নাস্তিকদের সরকার। শেখ হাসিনা ঘাবড়ে গেল। ষড়যন্ত্রকারীদের পাতা ফাঁদেই সে পা বাড়ালো। ২০১৪ এর নির্বাচনের পর আওয়ামীলীগ আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলো নিজেদের ধার্মিক প্রমাণ করার জন্যে। ঠিক যে ভুলটা বঙ্গবন্ধু করেছিল ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়ে ও মুসলিম দেশগুলোর মন যোগাতে আওয়ামীলীগের উপর হতে হিন্দুত্ববাদের অপবাদ দূর করতে। একই ফাঁদে বার বার। পরিণতি ভয়াবহ।

শেখ হাসিনার বিপদ এখন ত্রিমুখী। একদিকে পুরানো কৌশল হিন্দুত্ববাদী। শেখমুজিবকে বলা হত হিন্দুদের বাপ। আর শেখ হাসিনাকে বলা হচ্ছে হিন্দুদের মা। অন্যদিকে দলের ভেতরেও চোর বাটপারেরা এখন মাথাচাড়া দিয়ে গজিয়েছে। অপর দিকে নতুন একটি কৌশল যা কিছু মুক্তমনা, নাস্তিক নামধারীদের দিয়ে দেশের সেক্যুলার একটি অংশকে ক্ষেপিয়ে তোলা। জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ প্রবাদটি তো আর মিথ্যে নয়। এদের অপপ্রচার গোড়া থেকে শুরু হয়েছে। তাঁরা মুজিবকেও এখন ধর্মান্ধ, বিশেষ করে মৌলবাদী বানানোর পায়তারা শুরু করে দিয়েছে। কাজে লাগাচ্ছে মুজিবের সরল ধর্মবিশ্বাসকে।

ত্রিমূখী ষড়যন্ত্রে দিশাহারা শেখ হাসিনা আজ ভুল পথের পথযাত্রী। বাদশাহ আমানুল্লাকে সৎ পরামর্শ দেওয়ার জন্যে কামাল আতাতুর্ক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দেওয়ার জন্যে ফিদেল ক্যাস্ত্রো ছিলেন। শেখ হাসিনাকে সাবধান করার জন্যে কী আজ বিশ্বে আর কেউ বেঁচে নেই? জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের পাতা ফাঁদে পা দেওয়ার ফলেই কী আজ নও মুসলিম আব্দুল আজিজ প্রকাশ্যে বলতে পারছে হিন্দুদের মা হাসিনার পতনের পর হিন্দু দাদা ও আওয়ামীলীগের সেক্যুলারদের ধরে জবাই করা হবে? আওয়ামীলীগ ক্ষমতাচ্যুতের মাধ্যমে বাংলাদেশ যে আফগানস্থানের ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে তাঁর দায় কী কেবল শেখ হাসিনার? এদেশের সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের উপরেও কী সে দায় পড়বে না? নাকি তারাও বিক্রি হয়ে গেছে ডলারের কাছে?